
ছবি: সংগৃহীত
চার দিনের সরকারি সফরে আজ মঙ্গলবার (২৭ মে) রাতে জাপানের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করবেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। টোকিওতে অনুষ্ঠিতব্য ‘নিক্কেই সম্মেলন’-এ অংশগ্রহণ করাই এই সফরের প্রধান উদ্দেশ্য হলেও, সফরটি কেবল একটি সম্মেলনে অংশগ্রহণেই সীমাবদ্ধ থাকছে না—এ সফরকে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদারের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্ব হিসেবেই বিবেচনা করছে ঢাকা-টোকিও উভয়ই।
ড. ইউনূস ২৯ ও ৩০ মে টোকিওতে অনুষ্ঠেয় এশিয়ার অন্যতম প্রভাবশালী অর্থনৈতিক সম্মেলন ‘নিক্কেই ফোরাম: ফিউচার অব এশিয়া’-তে অংশ নেবেন। এ সম্মেলনে অংশ নিয়ে তিনি বিশ্বের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নেতৃত্বের সামনে বাংলাদেশের চলমান অর্থনৈতিক পরিবর্তন, উন্নয়ন লক্ষ্য ও ভবিষ্যৎ কৌশল তুলে ধরবেন। সম্মেলনের ফাঁকে তাঁর একাধিক উচ্চপর্যায়ের দ্বিপাক্ষিক বৈঠকেরও সূচি রয়েছে।
ড. ইউনূসের এই সফরকালে বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে সাতটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক (MoU) সই হওয়ার কথা রয়েছে। সোমবার (২৬ মে) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব রুহুল আলম সিদ্দিকী এসব তথ্য জানান। তিনি বলেন, “এই সফরের মাধ্যমে বাংলাদেশ-জাপান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও গভীর ও বহুমুখী হবে। সরকার ছাড়াও বিভিন্ন পর্যায়ের সাতটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষরিত হবে।”
চুক্তিগুলোর মধ্যে রয়েছে অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রযুক্তি হস্তান্তর, বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং জনশক্তি রপ্তানি সংক্রান্ত সমঝোতা। বিশেষ করে বাংলাদেশের দক্ষ শ্রমিকদের জাপানের শ্রমবাজারে প্রবেশাধিকার প্রসঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
সফরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে জাপানের কাছে এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকার ঋণ সহায়তা চাওয়া। পররাষ্ট্র সচিব জানান, এই ঋণ সহায়তা হবে সহজ শর্তে এবং স্বল্প সুদে, যা বাংলাদেশের মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং দুর্যোগ মোকাবিলায় সহায়তা করবে।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশ এখনো উন্নয়নশীল অবস্থানে থাকলেও উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় রয়েছে। তাই উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে জাপানের সঙ্গে সম্পর্ক আরও জোরদার করতে চাই আমরা।”
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আরও জানানো হয়, জাপানের শ্রমবাজারে বাংলাদেশি দক্ষ জনশক্তি রফতানির জন্য নতুন দিগন্তের সূচনা হতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যেই কিছু কার্যকরী আলোচনা হয়েছে, যা এই সফরে আনুষ্ঠানিকতা পাবে। বিশেষ করে নার্সিং, আইটি ও নির্মাণ খাতে বাংলাদেশের শ্রমিকদের চাহিদা বাড়ছে জাপানে।
এ সফরের মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই বিদ্যমান বাংলাদেশ-জাপান কৌশলগত অংশীদারিত্ব আরও শক্তিশালী হওয়ার আশা করছেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকেরা। বিশেষ করে আগামী অর্থবছরের বাজেট এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ কাঠামোর প্রেক্ষাপটে এই সফরের তাৎপর্য বাড়ছে।
ড. ইউনূসের এই সফর মূলত অর্থনৈতিক সম্পর্কের নতুন দিগন্ত উন্মোচনের পাশাপাশি কূটনৈতিক সম্পর্কেও এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে পারে। বাংলাদেশ সরকারের উন্নয়ন অগ্রাধিকার, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ এবং অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা জাপানিদের কাছে তুলে ধরার একটি বড় সুযোগ পাচ্ছে সরকার।
জাপান ঐতিহাসিকভাবেই বাংলাদেশের অন্যতম নির্ভরযোগ্য উন্নয়ন সহযোগী। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর, মেট্রোরেল, ইপিজেড ও বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ মেগা প্রকল্পে দেশটি আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জাপান সফর কেবল একটি সম্মেলনে অংশগ্রহণের আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং এটি অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক সম্প্রসারণের বাস্তবিক এবং তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ। এই সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ-জাপান অংশীদারত্ব আরও সুদৃঢ় হবে এবং দুই দেশের জনগণের কল্যাণে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে—এমনটাই প্রত্যাশা ঢাকা ও টোকিওর।
বাংলাবার্তা/এমএইচ