
ছবি: সংগৃহীত
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস চার দিনের সরকারি সফরে জাপানের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেছেন। বুধবার (২৮ মে) দিবাগত রাত ২টা ১০ মিনিটে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ক্যাথে প্যাসিফিক এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে তিনি টোকিওর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। এই সফরে তাঁর সঙ্গে রয়েছেন সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাবৃন্দ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ ও বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (BIDA) কয়েকজন সদস্য।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বাসসকে জানান, এই সফরটি আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থানকে আরও সুদৃঢ় করার এক বিশেষ প্রয়াস। সফরের মূল উদ্দেশ্য হলো জাপানের রাজধানী টোকিওতে আয়োজিত ‘নিক্কেই ফোরামের ফিউচার অব এশিয়া’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ, যেখানে তিনি এশিয়ার ভবিষ্যৎ ভূ-রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি বিষয়ে বক্তব্য রাখবেন।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, নীতিনির্ধারক, অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী এবং সাংবাদিকদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিতব্য এই সম্মেলনে অধ্যাপক ইউনূস বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একটি মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন। সেখানে তিনি বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, জলবায়ু অভিযোজন, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও সামাজিক ব্যবসায়িক ধারণার ভবিষ্যৎ প্রসারে সরকারের অঙ্গীকারের কথা তুলে ধরবেন।
সফরকালে অধ্যাপক ইউনূস জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবার সঙ্গে এক গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে মিলিত হবেন। এই বৈঠকে দুই দেশের মধ্যকার কৌশলগত সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে আলোচনা হবে। আলোচ্য বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে—বাংলাদেশে জাপানি বিনিয়োগ বাড়ানো, বাণিজ্য সম্প্রসারণ, কৃষি প্রযুক্তি স্থানান্তর, অবকাঠামো উন্নয়ন, বিশেষ করে রেলপথ এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সহায়তা।
এছাড়া উভয় দেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট আরও কিছু বিষয় আলোচনায় আসবে, যেমন—বাংলাদেশে চলমান রোহিঙ্গা সংকট ও এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা। জাপান এর আগেও রোহিঙ্গা পুনর্বাসন ও মানবিক সহায়তা কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এবার সেই ভূমিকাকে আরও বিস্তৃত করার প্রস্তাব এই বৈঠকে উপস্থাপন করা হবে বলে জানা গেছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এই সফরে বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে সাতটি গুরুত্বপূর্ণ খাতে সহযোগিতার লক্ষ্যে একাধিক সমঝোতা স্মারক (MoU) সই হওয়ার কথা রয়েছে। সম্ভাব্য চুক্তিগুলোর মধ্যে রয়েছে—জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে যৌথ বিনিয়োগ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ডিজিটাল প্রযুক্তিতে সহযোগিতা, কৃষি গবেষণা ও উদ্ভাবন, শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং অবকাঠামো খাতে প্রযুক্তি স্থানান্তর।
বিশেষ করে ঢাকা থেকে পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ আরও উন্নত করতে জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী রেলপথকে ডুয়েল-গেজ ডাবল ট্র্যাকে উন্নীত করার প্রকল্পের বিষয়ে ‘নোট ভারবাল’ বা ‘নোট অব এক্সচেঞ্জ’ সই হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে দেশের অভ্যন্তরীণ মালবাহী ও যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচলে উল্লেখযোগ্য গতি ও দক্ষতা আসবে।
অধ্যাপক ইউনূস এ সফরে শুধু রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে নয়, জাপানের বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন, বৃহৎ করপোরেট গ্রুপ এবং শিল্প উদ্যোক্তাদের সঙ্গেও পৃথক পৃথক বৈঠকে মিলিত হবেন। তিনি বাংলাদেশে বিনিয়োগের সম্ভাবনা, উদ্যোক্তা পরিবেশ, অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর সুযোগ-সুবিধা এবং সামাজিক ব্যবসা ধারণাকে তুলে ধরবেন। এ ছাড়া ‘স্টার্টআপ বাংলাদেশ’ ইনিশিয়েটিভের মাধ্যমে প্রযুক্তি-ভিত্তিক যৌথ উদ্যোগ গঠনের প্রস্তাবও রাখা হবে বলে জানা গেছে।
জাপানের জ্যেষ্ঠ আমলাদের সঙ্গেও তাঁর আলোচনার কথা রয়েছে, যেখানে উন্নয়ন সহযোগিতা, সরকারি অনুদান, শিক্ষা-বিনিময় কর্মসূচি এবং জলবায়ু সহনশীল অবকাঠামো নির্মাণে সহায়তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই সফর দুই দেশের সম্পর্ককে কৌশলগত অংশীদারিত্বে রূপান্তর করার ক্ষেত্রে একটি বড় অগ্রগতি হিসেবে বিবেচিত হবে। একইসঙ্গে এটি বাংলাদেশকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জাপানের প্রাধান্যপূর্ণ অর্থনৈতিক সহযোগী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
সফর শেষে আগামী ৩১ মে, শনিবার, অধ্যাপক ইউনূসের ঢাকায় ফেরার কথা রয়েছে। তাঁর সঙ্গে সফরসঙ্গীরা দেশে ফিরে এসে জাপানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ বিষয়গুলোর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া শুরু করবেন বলে জানিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়।
এই সফরকে ঘিরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ ঘনিষ্ঠ সমন্বয়ে কাজ করছে, যাতে করে চুক্তিগুলো বাস্তব রূপ নিতে পারে এবং দুই দেশের মধ্যে আরও দীর্ঘমেয়াদি ও ফলপ্রসূ সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ