
ছবি: সংগৃহীত
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এক ভয়াবহ খবরে মঙ্গলবার (২৭ মে) সারা বিশ্বের মুসলমানদের মধ্যে চরম উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে। সংবাদটি ছিল—মৌরিতানিয়া থেকে সৌদি আরবগামী একটি বিমান, যাতে ২১০ জন হজযাত্রী ছিলেন, সেটি লোহিত সাগরের উপকূলে বিধ্বস্ত হয়েছে। প্রাথমিকভাবে কেউ এই তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করতে পারেনি, তবে দাবি করা হয়, হজযাত্রী বহনকারী বিমানটির সঙ্গে রহস্যজনকভাবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং পরে সেটি সাগরের উপকূলে বিধ্বস্ত হয় বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
খবরটি দ্রুত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। কিছু কিছু পেজে একটি ভিডিওও ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে দেখা যায়, বিমানের ভেতরে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে, যাত্রীরা চিৎকার করছেন, এবং বারবার “আল্লাহু আকবার” ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। ভিডিওটি দেখে অনেকেই ধারণা করেন, এটি মৌরিতানিয়ার সেই বিধ্বস্ত বিমানের ফুটেজ। ভক্তিমূলক আবেগে কেউ কেউ ভিডিওটি শেয়ার করে বলতে থাকেন, “হজযাত্রার পথে শহিদ হলেন তারা, আল্লাহ তাদের কবুল করুন।”
কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই মৌরিতানিয়ান এয়ারলাইন্স এবং দেশটির সরকারি সূত্র এসব তথ্যকে ‘ভিত্তিহীন ও গুজব’ বলে ঘোষণা করে। একটি আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে মৌরিতানিয়ান এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করে, “আলহামদুলিল্লাহ, আমাদের সব হজযাত্রী নিরাপদে সৌদি আরব পৌঁছেছেন। নির্ধারিত সব ফ্লাইট স্বাভাবিকভাবে পরিচালিত হয়েছে। কোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেনি।”
সংস্থাটি আরো জানায়, “গুজব রটনাকারীদের শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি, তারা যেন যাচাই না করে এ ধরনের বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়াবেন না।”
মৌরিতানিয়ার বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ এবং ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকেও বিষয়টি স্পষ্ট করে জানানো হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র বলেন, “এ বছর মৌরিতানিয়া থেকে সৌদিতে হজে যাওয়ার জন্য যে সংখ্যক ফ্লাইট নির্ধারিত হয়েছে, তার সবকটিই নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছেছে। কোনো হজযাত্রী নিখোঁজ কিংবা দুর্ঘটনার শিকার হননি। ফলে বিধ্বস্তের যে খবরটি ছড়ানো হয়েছে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট।”
অন্যদিকে, আরবভিত্তিক গণমাধ্যম এমএএসডিআর নিউজ এক অনুসন্ধান প্রতিবেদনে জানায়, সামাজিক মাধ্যমে যেসব ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে, সেগুলোর একটিও প্রকৃত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। ছড়ানো ভিডিওটি ২০১৯ সালে আফ্রিকার একটি অন্য দেশের বিমান সংক্রান্ত এক ঘটনায় তৈরি একটি নাট্য-ভিত্তিক ক্লিপ। ভিডিওটির শব্দ ও ছবি সম্পাদনার মাধ্যমে নতুন করে “বিধ্বস্ত” বিমানের মত করে পরিবেশন করা হয়।
এ প্রসঙ্গে মৌরিতানিয়ার ডিজিটাল নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ এল-সিদি বলেন, “গুজব ছড়ানো এখন একটি ডিজিটাল অপরাধ। মানুষ যখন আবেগপ্রবণ হয়, তখন যাচাই না করেই অনেক কিছু বিশ্বাস করে বসে। এই সুযোগটাই নিচ্ছে কিছু ভুয়া অ্যাকাউন্ট ও অনলাইন ট্রল গ্রুপ। এগুলোর বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।”
গণমাধ্যম ও বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি সৌদি হজ কর্তৃপক্ষও নিশ্চিত করেছে, হজ মৌসুমে অংশ নিতে আসা কোনও দেশের যাত্রীদের সঙ্গে এমন কোনো দুর্ঘটনা বা বিমান সংকট ঘটেনি।
মৌরিতানিয়ার ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট হজযাত্রীদের পরিবারের জন্য স্বস্তির বার্তা দিয়ে বলে, “পরিবারগুলো উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। যেসব যাত্রীকে নিয়ে গুজব ছড়ানো হয়েছে, তাদের সবাই মদিনা ও মক্কায় নিরাপদভাবে পৌঁছেছেন এবং হজের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত রয়েছেন।”
মৌরিতানিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং সাইবার অপরাধ দমন শাখা বিষয়টি তদন্ত করছে। তারা জানিয়েছে, ইচ্ছাকৃতভাবে ভুয়া ভিডিও ছড়িয়ে জনমনে আতঙ্ক ও বিভ্রান্তি সৃষ্টির অভিযোগে কয়েকটি ফেসবুক পেজ, ইউটিউব চ্যানেল এবং একাধিক টুইটার অ্যাকাউন্টের কার্যক্রম নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
এই ঘটনাটি আবারও মনে করিয়ে দেয়—ভুয়া খবর বা গুজব কতটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং কীভাবে তা নিরীহ মানুষের মানসিক শান্তি ছিনিয়ে নিতে পারে। তাই দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে প্রত্যেকের উচিত যেকোনো তথ্য আগে যাচাই করে শেয়ার করা, বিশেষ করে তা যদি জীবন ও মৃত্যুর মতো স্পর্শকাতর বিষয় হয়।
মৌরিতানিয়ার ২১০ হজযাত্রী নিয়ে কোনো বিমান দুর্ঘটনা ঘটেনি। গুজবে কান না দিয়ে নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে তথ্য যাচাই করার আহ্বান জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ