
ছবি: সংগৃহীত
রাতের নিরবতা ভেঙে হঠাৎই নেমে আসে মৃত্যু। গাজার ফাহমি আল-জারজাওয়ি স্কুল, যেটি যুদ্ধের এই সময়টিতে একটি নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিল, রোববার দিবাগত রাতের অন্ধকারে রূপ নেয় একটি জ্বলন্ত মৃত্যুকূপে। ঘুমন্ত শিশু, নারী আর অসহায় মানুষের আশ্রয়স্থলটি মুহূর্তেই পরিণত হয় আগুনের লেলিহান শিখায়।
সেই আগুনের মধ্য দিয়েই বেঁচে ফিরে আসে সাত বছরের এক ছোট্ট মেয়ে—ওয়ার্দ শেখ খলিল। মেয়েটি যখন নিজের ক্লাসরুম থেকে আগুন ঠেলে বেরিয়ে আসে, তখন তার চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল মানুষজনের আর্তনাদ, পোড়া মাংসের গন্ধ আর দগ্ধ শরীরের অস্পষ্ট ছায়া। এই দৃশ্য সোমবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওটি দেখতে না চাইলেও কেউ আর চোখ ফিরিয়ে রাখতে পারেননি।
ঘটনার পরদিন মঙ্গলবার, হাসপাতালে বিছানায় বসে চাচা ইয়াদ মুহাম্মদ আল শিক খলিলকে ওয়ার্দ জানায় সেই বিভীষিকাময় রাতের কথা—‘মিসাইলটা আমাদের ওপরই পড়ল। স্কুলটা আগুনে জ্বলে উঠল। আর চোখের সামনে আমি আমার মা ও ভাইবোনকে পুড়তে দেখেছি।’
ঘটনাটি ঘটে গাজা উপত্যকার দক্ষিণাঞ্চলে, খান ইউনুসের উপকণ্ঠে অবস্থিত ফাহমি আল-জারজাওয়ি স্কুলে। স্কুলটি ইউনাইটেড নেশনস রিলিফ অ্যান্ড ওয়ার্কস এজেন্সি ফর প্যালেস্টাইন রিফিউজিস ইন দ্য নিয়ার ইস্ট (UNRWA)-এর একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলেও, ইসরায়েলি আগ্রাসনের মধ্যে এটি আশ্রয়কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল।
ওই রাতে স্কুলটিতে অবস্থান করছিল কয়েক শতাধিক উদ্বাস্তুর মতো খলিল পরিবারের সদস্যরাও। হামলা শুরু হয় রাত প্রায় দুইটার দিকে। একের পর এক বোমা বিস্ফোরণে দগ্ধ হতে থাকে ক্লাসরুমগুলো। আগুনে ভস্মীভূত হয় পুরো ভবন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ফলে পুরো স্কুলে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। অধিকাংশ মানুষ তখন ঘুমিয়ে ছিলেন। বাঁচার জন্য কেউ কিছুই করতে পারেননি। আলজাজিরা ও সিবিসি নিউজের তথ্য অনুযায়ী, স্কুলে সরাসরি বোমা হামলায় নিহত হন অন্তত ৩৬ জন। এর মধ্যে ১৮ জন শিশু ও ৬ জন নারী ছিলেন।
সেই বিভীষিকাময় রাতে ওয়ার্দ হারিয়েছে তার মা ও ছয় ভাইবোনকে। ভাইবোনদের বয়স ছিল মাত্র ২ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে। তারা সবাই হামলার সময় ঘুমিয়ে ছিলেন এবং কেউ-ই বাঁচতে পারেননি। সিবিসি নিউজের খবরে বলা হয়েছে, ওয়ার্দের বাবা ও আরেক ভাই গুরুতর দগ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, এবং তাদের অবস্থা আশঙ্কাজনক। আগুনের ভেতর দিয়ে ক্লাসরুম থেকে হেঁটে বেরিয়ে আসতে দেখে উদ্ধারকর্মীরা ওয়ার্দকে উদ্ধার করে তাৎক্ষণিক হাসপাতালে ভর্তি করেন।
ওয়ার্দের চাচা ইয়াদ মুহাম্মদ বলেন, ‘আমি খবর পেয়েছিলাম যে আমার ভাইয়ের পরিবার যে স্কুলে ছিল সেটিতে বোমা পড়েছে। ছুটে যেতে চাইলেও পারিনি। চারপাশে তখনও গোলাবর্ষণ চলছিল। ঘোর অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না।’
তিনি আরও বলেন, ‘ভোরে যখন ঘটনাস্থলে পৌঁছাই, তখন চারপাশে শুধু ধোঁয়া, পোড়া গন্ধ আর ছড়িয়ে থাকা মানুষের দেহের খণ্ডাংশ। আমরা প্রথমে লাশ খুঁজছিলাম, পরে কেবল দেহের টুকরো খুঁজতে থাকি—হাত, পা, আঙুল, পোড়া কাপড়। লাশ শনাক্ত করা দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছিল।’
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় অব্যাহতভাবে ভয়াবহ হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। তাদের হামলার প্রধান লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠেছে স্কুল, হাসপাতাল, বাজার এবং শরণার্থী শিবিরগুলো—যা যুদ্ধবিধ্বস্ত জনগণের জন্য অস্থায়ী নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
ফাহমি আল-জারজাওয়ি স্কুলে হামলার আগে গত বছর আগস্টে ইসরায়েলি বাহিনী গাজা নগরীর আল-তাবিন স্কুলে আরেকটি ভয়াবহ হামলা চালিয়েছিল। তখনও বহু শিশু নিহত হয়েছিল। জাতিসংঘ বারবার গাজার স্কুল ও হাসপাতালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানালেও, ইসরায়েলি বাহিনী এসব সতর্কতাকে উপেক্ষা করে যাচ্ছে।
গাজার হাজারো শিশুর মতো ওয়ার্দও বেঁচে আছে। কিন্তু কীভাবে? মায়ের জ্বলন্ত মৃতদেহ, ভাইবোনদের আর্তনাদ আর পোড়া গন্ধ তার স্মৃতিতে গেঁথে থাকবে আজীবন। হাসপাতালের বিছানায় বসে সে এখনো জানে না—তার বাবা ও ভাই বেঁচে আছে কিনা। আর এই যুদ্ধ থেমে যাবে কি না, তাও কেউ জানে না।
ওয়ার্দের মতো শত শত শিশু, নারী ও বৃদ্ধ প্রতিদিন হারাচ্ছে পরিবার, হারাচ্ছে ঘর, হারাচ্ছে নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ। অথচ বিশ্ব এখনো নীরব—অথচ প্রতিটি সন্ত্রাসী আক্রমণের পর চিৎকার করে মানবতা রক্ষার কথা বলে তারা।
গাজা থেকে প্রতিদিন যেসব ছোট ছোট কণ্ঠ চিৎকার করে বাঁচতে চায়—তা হয়তো আর কেউ শোনে না। ওয়ার্দের সেই শেষ বাক্যটিই হয়ে উঠছে গোটা পৃথিবীর বিবেকের প্রতি এক করুণ আর্তি—
“আমি আমার মা আর ভাইবোনদের পুড়তে দেখেছি।”
এই আর্তনাদ কি কেউ শুনবে?
বাংলাবার্তা/এমএইচ