
ছবি: সংগৃহীত
গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর (আইডিএফ) অব্যাহত বিমান হামলায় নতুন করে আরও ৮১ ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে শুধু গাজা শহরেই প্রাণ হারিয়েছেন ৫৩ জন। আহত হয়েছেন আরও অন্তত ১৬৯ জন ফিলিস্তিনি নাগরিক। রোববার সন্ধ্যা থেকে সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত এই হামলা চলে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে এই তথ্য নিশ্চিত করেছে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরাও বিষয়টি নিশ্চিত করে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, বাস্তবে হতাহতের সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। কারণ হামলায় ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবনের নিচে অনেকেই এখনও চাপা পড়ে আছেন। উদ্ধার কাজ চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হলেও টানা বোমা বর্ষণের মধ্যে উদ্ধারকর্মীদের কাজ ব্যাহত হচ্ছে। ফলে নির্দিষ্ট করে মৃতের সংখ্যা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। অনেক পরিবার এখনও তাদের স্বজনদের কোনো খোঁজ পাচ্ছে না। ফলে নিখোঁজদের সংখ্যাও বাড়ছে।
গাজায় ইসরাইলি বাহিনীর এই হামলা নতুন নয়। দীর্ঘ ১৫ মাস ধরে এই অঞ্চলজুড়ে তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছে আইডিএফ। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ‘অক্টোবর হামলা’ নামে পরিচিত ঘটনায় গাজা নিয়ন্ত্রণকারী ইসলামপন্থি গোষ্ঠী হামাসের যোদ্ধারা ইসরাইলের দক্ষিণাঞ্চলে প্রবেশ করে আকস্মিক হামলা চালায়। হামলায় ১ হাজার ২০০ জন ইসরায়েলি নিহত হন এবং আরও ২৫১ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয়।
এই ঘটনার পরপরই পাল্টা প্রতিশোধ ও জিম্মিদের উদ্ধারের ঘোষণা দিয়ে গাজায় সর্বাত্মক অভিযান শুরু করে ইসরাইলি বাহিনী। শুরু হয় ইতিহাসের অন্যতম দীর্ঘ ও ভয়াবহ সামরিক অভিযানের এক পর্ব, যা আজও থামেনি। এই দীর্ঘ অভিযানে গাজা পরিণত হয়েছে মৃত্যুপুরীতে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত গাজায় মোট ৫৩ হাজার ৯৭৭ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও ১ লাখ ২২ হাজার ৯৬৬ জন। নিহতদের মধ্যে নারী ও শিশু মিলিয়ে সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫৬ শতাংশ। যার মানে, গড়ে প্রতি দুইজন নিহতের একজনই নারী বা শিশু।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পরিসংখ্যান শুধু একটি মানবিক বিপর্যয়ের কথা বলে না, এটি বিশ্ব বিবেকের একটি প্রশ্নও হয়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো এবং জাতিসংঘ বারবার উদ্বেগ প্রকাশ করলেও সংঘর্ষ থামছে না।
চলমান সংঘর্ষের মাঝখানে ২০২৪ সালের ১৯ জানুয়ারি, আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ইসরাইল কিছুদিনের জন্য যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেয়। এই বিরতি কার্যকর থাকলেও তা স্থায়ী হয়নি। মার্চ মাসের ১৮ তারিখে ফের গাজায় নতুন করে সামরিক অভিযান শুরু করে আইডিএফ। বলা হয়, জিম্মি উদ্ধার অভিযান এবং ‘সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর’ অবকাঠামো ধ্বংস করাই ছিল লক্ষ্য।
এই দ্বিতীয় দফার অভিযানে গত আড়াই মাসে আরও ৩ হাজার ৮২২ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন প্রায় ১১ হাজার। স্থানীয়রা বলছেন, যুদ্ধবিরতি শেষে যেসব হামলা হচ্ছে, তা আগের চেয়েও বেশি ধ্বংসাত্মক। আর এই হামলা শুধু শহর নয়, গাজার বিভিন্ন শরণার্থী শিবির, স্কুল, হাসপাতাল এবং বাজার এলাকায়ও পরিচালিত হচ্ছে।
হামাসের হাতে থাকা ২৫১ জন জিম্মির মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে কিছু জিম্মিকে মুক্ত করা সম্ভব হলেও এখনো প্রায় ৩৫ জন জিম্মি জীবিত রয়েছেন বলে ধারণা করছে ইসরাইলি সেনাবাহিনী। আইডিএফের মুখপাত্র এক বিবৃতিতে বলেন, তারা সব জিম্মিকে উদ্ধারে সামরিক অভিযানের পথ বেছে নিচ্ছে এবং এই লক্ষ্য অর্জনে সম্ভাব্য সব কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে।
তবে এই ধরনের অভিযানে গাজায় বাস করা সাধারণ মানুষের জীবন আরও বিপন্ন হচ্ছে। আইডিএফ বারবার দাবি করলেও, বাস্তবে প্রতিটি সামরিক অভিযানে নিহতদের বড় অংশই বেসামরিক নাগরিক। শিশু, নারী, বৃদ্ধ—কোনো শ্রেণি এই হামলা থেকে রেহাই পাচ্ছে না।
এত দীর্ঘ সময় ধরে এই ধরনের সামরিক অভিযান চলা এবং এতো বিশাল সংখ্যক প্রাণহানির ঘটনায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ক্ষোভ বাড়ছে। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এ সংঘর্ষ বন্ধে মধ্যস্থতার চেষ্টা চালালেও তা কার্যকর হচ্ছে না।
গাজার পরিস্থিতি বর্তমানে এতটাই ভয়াবহ যে খাদ্য, চিকিৎসা, পানি ও বাসস্থানের চরম সংকট দেখা দিয়েছে। জাতিসংঘ বলছে, গাজার প্রায় ৯৫ শতাংশ জনগণ এখন মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। বহু পরিবার আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে, অনেকেই অনাহারে দিন কাটাচ্ছে।
একদিকে ইসরাইলি বাহিনীর ধারাবাহিক বোমা হামলা, অন্যদিকে গাজার ধ্বংসপ্রাপ্ত অবকাঠামো ও মৃতের পাহাড়—এই দুটি মিলেই বর্তমান গাজা উপত্যকার ছবি। প্রতিদিন গড়ে কয়েক ডজন ফিলিস্তিনি বোমায় নিহত হচ্ছেন, আহত হচ্ছেন শত শত মানুষ। শিশুদের কান্না, মায়েদের আহাজারি, বিধ্বস্ত ভবনের নিচে চাপা পড়ে যাওয়া মানুষের আর্তনাদ যেন বিশ্ব বিবেককে বারবার প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে—এই যুদ্ধ আর কতদিন চলবে?
এই হামলার অবসান এবং একটি টেকসই শান্তি চুক্তির প্রত্যাশায় প্রতিদিনই বিশ্বজুড়ে বাড়ছে উদ্বেগ, তবুও গাজা যেন রক্তাক্তই থেকে যাচ্ছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ