
ছবি: সংগৃহীত
বিশ্বের প্রযুক্তি অঙ্গনে বর্তমানে এক নতুন ‘অস্ত্র প্রতিযোগিতা’ শুরু হয়েছে, যার মূল কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই (Artificial Intelligence)। এই প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্র ও চীন দুই পরাশক্তি হিসেবে একে অন্যের সঙ্গে লড়ে যাচ্ছে, আর তাদের কৌশল এবং লক্ষ্য ভিন্ন। সম্প্রতি প্রকাশিত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ম্যাগাজিন দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের প্রাধান্য রক্ষা ও বিস্তার ঠেকাতে চীন একটি অভিনব ও বাস্তবমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, যা প্রযুক্তি বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এআই উন্নয়নকে ‘অস্ত্র প্রতিযোগিতা’ হিসেবে দেখা হচ্ছে। গত ২১ মে যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স এক বিবৃতিতে উল্লেখ করেন, যদি যুক্তরাষ্ট্র এআই নিরাপত্তা এবং উন্নয়ন কাজে পিছিয়ে যায়, তবে তারা ‘চীনা নিয়ন্ত্রিত এআই-এর দাসে পরিণত’ হতে পারে। অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্র বুঝতে পেরেছে, এআই আধিপত্য ধরে রাখা ভবিষ্যতের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার জন্য অপরিহার্য। এর ফলে তারা প্রযুক্তিগত গবেষণা ও উন্নয়নে বিশাল বিনিয়োগ শুরু করেছে। উদাহরণস্বরূপ, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত ১৫ মে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে একটি এআই সম্পর্কিত চুক্তি সই করেন, যা যুক্তরাষ্ট্রের ‘এআই আধিপত্য’ নিশ্চিত করার একটি স্ট্র্যাটেজিক পদক্ষেপ। এছাড়া ২০৩০ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য এক ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে এআই মডেল পরিচালনার জন্য অত্যাধুনিক ডেটা সেন্টার নির্মাণ করা, যা বিশ্বের বৃহত্তম এআই অবকাঠামো হিসেবে কাজ করবে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি জায়ান্টগুলো—যেমন ওপেনএআই, মাইক্রোসফট, এএমডি এবং কোরওয়েভ—সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি নিয়ন্ত্রণ কমানোর পক্ষে লবিং করেছে, যাতে তারা উদ্ভাবনী কার্যক্রমে দ্রুত এগিয়ে যেতে পারে। এআই উন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরণের উদ্যোগগুলো বিশ্ববাজারে তার আধিপত্য বজায় রাখার অন্যতম হাতিয়ার। কিন্তু এআই প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্রের এগিয়ে থাকা বা আধিপত্যই যেন চীনের পরিকল্পনায় বড় বাধা।
অন্যদিকে, চীন এআই প্রতিযোগিতায় পুরোপুরি ভিন্ন কৌশল হাতে নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র যখন এআই-র ভবিষ্যৎ নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা ও পরিকল্পনায় ব্যস্ত, চীনা সরকার তাৎক্ষণিক এবং বাস্তব প্রয়োগে মনোযোগ দিচ্ছে। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এপ্রিল মাসে এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে বলেন, “এআইকে পারমাণবিক অস্ত্রের মতো নয়, বরং বিদ্যুতের মতো একটি প্রযুক্তি হিসেবে দেখতে হবে, যার ব্যবহারিক দিকই মুখ্য।” এই বক্তব্যই স্পষ্ট করে দেয় চীনের কৌশল: তারা প্রযুক্তির ব্যবহারিক ও অর্থনৈতিক প্রভাবের দিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে, যা দ্রুত এবং ব্যাপকভাবে শিল্প ও ভোক্তা পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে চায়।
চীনা সরকারের ‘এআই+’ নামে এক নতুন কর্মসূচি শুরু হয়েছে, যা মূলত এআইকে বিদ্যমান শিল্প, উৎপাদন ব্যবস্থায় সংযুক্ত করার লক্ষ্যে পরিচালিত হচ্ছে। এটি এক দশক আগের ‘ইন্টারনেট+’ কর্মসূচির ধারাবাহিকতা, যা চীনকে একটি আধুনিক ডিজিটাল অর্থনীতি হিসেবে গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ‘এআই+’ কর্মসূচির মাধ্যমে চীন চায় দেশের প্রতিটি শিল্পখাত, কৃষি, উৎপাদন থেকে শুরু করে সেবা খাত পর্যন্ত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রযুক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করতে। এর ফলে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো আরও শক্তিশালী হবে এবং বিশ্ববাজারে তার প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান আরও দৃঢ় হবে।
তবে চীন শুধু এআই অনুকরণ বা উন্নত মডেলের অনুসরণকারী হিসেবে থেমে থাকতে চায় না। দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন জানাচ্ছে, চীন সরকারি অর্থায়নে এমন একধরনের গবেষণা চালাচ্ছে যা সম্পূর্ণ নতুন কাঠামোতে এআই বা এজিআই (Artificial General Intelligence) তৈরি করবে। উদাহরণস্বরূপ, ছবি বিশ্লেষণের মাধ্যমে বাস্তব বিশ্বের সঙ্গে সরাসরি ইন্টারঅ্যাকশন করতে সক্ষম এমন মডেল তৈরির চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি এমন এআই প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা চলছে যা সরাসরি মানুষের মস্তিষ্কের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারবে—যা বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর মত শোনালেও বাস্তবে খুব কাছাকাছি আসছে।
চীনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হচ্ছে পশ্চিমা বিশ্বের প্রযুক্তি ও এআই উদ্ভাবনকে অনুসরণ করে তা ওপেন সোর্স করা এবং মুক্তভাবে ব্যবহারযোগ্য করে তোলা, যাতে যুক্তরাষ্ট্রের একচেটিয়া আধিপত্য ভেঙে যায়। উদাহরণস্বরূপ, এই বছরের জানুয়ারিতে চীনের ডিপসিক নামক একটি প্রতিষ্ঠান একটি ভাষা মডেল উন্মোচন করেছে, যা ওপেনএআই-এর জনপ্রিয় মডেলগুলোর সমতুল্য। এই মডেলের গঠনমূলক উপাদানগুলো চীন মুক্তভাবে বিশ্ববাসীর জন্য উন্মুক্ত করেছে, যা স্পষ্ট বার্তা দেয়—ভবিষ্যতে এআই প্রযুক্তির বাজারে মূল্য নির্ধারণ হবে মডেলের নির্মাণে নয়, বরং তার ব্যবহার ও প্রয়োগে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) সম্প্রতি একটি প্রতিবেদনে জানিয়েছে, আগামী দশকে এআই যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে ৫.৬ শতাংশ বাড়াতে পারে, যেখানে চীনের অর্থনীতি বৃদ্ধি পাবে ৩.৫ শতাংশ। এর পেছনে একটি বড় কারণ হলো, চীনের সেবা খাত এখনও ছোট এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির সুযোগ সীমিত। তবে চীনের পরিকল্পনা এবং কৌশল এদিক থেকে ভিন্ন, যা দ্রুত গতিতে উন্নয়ন নিশ্চিত করবে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, চীনের এআই ব্যবহারে বাস্তবমুখী পরিকল্পনা এবং সরকারের সক্রিয় অর্থায়ন তাকে দ্রুত এগিয়ে নিতে সাহায্য করবে। এর মাধ্যমে চীন শুধু প্রযুক্তিতে এগিয়ে থাকবে না, বরং এআইয়ের ব্যবহার ভোক্তা জীবন, শিল্প উৎপাদন, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং সামরিক ক্ষেত্রে ব্যাপক হারে প্রসারিত হবে।
বিশ্বব্যাপী এআই প্রযুক্তির প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন উভয়ই নিজেদের স্বার্থ প্রতিষ্ঠায় নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টা প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মাধ্যমে আধিপত্য বজায় রাখা, অন্যদিকে চীন তার বাস্তব প্রয়োগ, খোলা নকশা এবং আর্থ-সামাজিক সমন্বয়ের মাধ্যমে দ্রুত অগ্রগতি সাধন করছে। এই প্রতিযোগিতা ভবিষ্যতে কিভাবে রূপ নেবে তা আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মহলে নজরকাড়া বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এমন একটি জটিল প্রতিযোগিতার মধ্যে বিশ্ববাসী অপেক্ষায় রয়েছে, কে হবে এআই প্রযুক্তির ভবিষ্যতের অধিপতি—যুক্তরাষ্ট্রের উদ্ভাবনী ক্ষমতা নাকি চীনের বাস্তবমুখী ও ব্যাপক প্রয়োগ কৌশল? অবশ্যই এই দ্বৈরথ ভবিষ্যতের বিশ্বঅর্থনীতির দিকনির্দেশক হিসেবে কাজ করবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ