
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খানের বিরুদ্ধে আবারও প্রবলভাবে মাঠে নেমেছেন সংস্থাটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এনবিআর সংস্কার নিয়ে চলমান উত্তেজনার মধ্যে এবার প্রথমবারের মতো তারা সময়সীমা নির্ধারণ করে তাঁর অপসারণ দাবি করেছেন।
‘এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ’ নামের আন্দোলনরত প্ল্যাটফর্মটি সোমবার (২৭ মে) এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করে, বর্তমান চেয়ারম্যানের অধীনে এনবিআরের অভ্যন্তরে কর্মীদের মধ্যে চরম আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়েছে। তিনি পদে থাকলে এনবিআরের কার্যক্রম আরও স্থবির হয়ে পড়বে বলেও তারা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন।
সংবাদ সম্মেলনে পরিষদের নেতারা সাফ জানিয়ে দেন, আগামী ২৯ মে’র মধ্যে চেয়ারম্যানকে অপসারণ করতে হবে। অন্যথায় আন্দোলনের নতুন ধাপ ঘোষণা করা হবে। তারা আরও জানান, পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী চেয়ারম্যানের সঙ্গে ‘লাগাতার অসহযোগ’ কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।
আন্দোলনকারীরা বলেন, রাজস্ব প্রশাসনে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে, রাজনৈতিক প্রভাব ও অদক্ষ নেতৃত্বের হাত থেকে প্রতিষ্ঠানটিকে মুক্ত করতেই এই পদক্ষেপ। তাঁদের ভাষায়, “জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের দায়িত্বশীল পদে এমন একজন কর্মকর্তা থাকা উচিত, যিনি এই খাতের জ্ঞান, দক্ষতা ও বাস্তব অভিজ্ঞতায় পারদর্শী।”
পরিষদের লিখিত বক্তব্যে আরও বলা হয়, “আমরা আশা করি রাষ্ট্র ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে সরকার এমন একজন কর্মকর্তাকে চেয়ারম্যান পদে পূর্ণকালীন দায়িত্ব প্রদান করবেন, যিনি কর নীতি প্রণয়ন ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় দক্ষ।”
চলমান এই আন্দোলনের পেছনে রয়েছে এনবিআরকে দুটি আলাদা বিভাগে ভাগ করার সরকারি সিদ্ধান্ত। ১২ মে রাতে সরকার হঠাৎ ‘রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ, ২০২৫’ নামে একটি অধ্যাদেশ জারি করে। এতে এনবিআরের বর্তমান কাঠামো ভেঙে দুইটি আলাদা বিভাগ গঠনের কথা বলা হয়, যা এনবিআরের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে তীব্র অসন্তোষ তৈরি করে।
পরদিন থেকেই অবস্থান কর্মসূচি, কলমবিরতি এবং অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নেন কর্মীরা। তাঁরা মনে করেন, এই বিভাজন কৌশলগতভাবে এনবিআরের ক্ষমতা হ্রাস করবে এবং কর প্রশাসন দুর্বল হয়ে পড়বে। একপর্যায়ে আন্দোলনের চাপে পড়ে অর্থ মন্ত্রণালয় ঘোষণা দেয় যে এনবিআর বিলুপ্ত করা হচ্ছে না, বরং একে একটি ‘স্বাধীন ও বিশেষায়িত বিভাগে’ উন্নীত করা হবে।
সরকারি আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে রোববার রাতে এনবিআরের আন্দোলনকারীরা কর্মবিরতিসহ সব কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেন। তবে তারা স্পষ্ট করে দেন, এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণসহ কিছু দাবির এখনো বাস্তবায়ন হয়নি, এবং এই বিষয়ে তারা আপসহীন অবস্থানে রয়েছেন।
এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের নেতারা বলেন, “এটা স্পষ্ট যে এনবিআর চেয়াম্যানের পদত্যাগ ছাড়া আমরা বিশ্বাসযোগ্য সংস্কার আশা করতে পারি না। যে ব্যক্তি স্বতঃপ্রণোদিতভাবে একটি গভীর বিতর্কিত অধ্যাদেশ বাস্তবায়নে উদ্যোগী হয়েছেন, তিনি কিভাবে পরে সেই সংস্কারের অভিভাবক হবেন?”
সংবাদ সম্মেলনে ঐক্য পরিষদ আরও দাবি জানায়, এনবিআর সংস্কার বিষয়ে গঠিত পরামর্শক কমিটির প্রতিবেদন অবিলম্বে ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে। তাদের অভিযোগ, সরকার জনস্বার্থে গঠিত এই কমিটির সুপারিশগুলো এখন পর্যন্ত গোপন রেখেছে, যা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার পরিপন্থী।
তারা উল্লেখ করেন, “সরকার যদি সত্যিই স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় এনবিআর সংস্কার করতে চায়, তবে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের মতামত ও প্রস্তাব সর্বসমক্ষে প্রকাশ করা জরুরি।”
সরকার ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে অধ্যাদেশে সংশোধনী আনা হবে এবং এ বিষয়ে এনবিআর, পরামর্শক কমিটি এবং সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ জানিয়েছে, তারা এই সময়সীমার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকলেও সংশোধনী প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ এবং কার্যকর দেখতে চায়।
তারা বলেন, “আমরা আশা করি, সংশ্লিষ্ট সংশোধনীগুলো বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকার দ্রুত আলোচনা শুরু করবে এবং অগ্রগতি দৃশ্যমান হবে।”
চলমান এই পরিস্থিতি স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেয় যে, এনবিআর সংস্কারকে কেন্দ্র করে রাজস্ব প্রশাসনের ভেতরে এখনও তীব্র টানাপড়েন বিরাজ করছে। সরকার একদিকে পরিস্থিতি শান্ত রাখতে চাইছে, অন্যদিকে আন্দোলনরত পক্ষ নিজেদের দাবিতে অনড়।
চেয়ারম্যান পদ নিয়ে নতুন করে এই সময়সীমা নির্ধারণ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করতে পারে, যদি না সরকার দ্রুত কোনও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করে। এখন দেখার বিষয়—২৯ মে’র মধ্যেই এনবিআরের নেতৃত্বে পরিবর্তন আসে কিনা, নাকি আন্দোলন ফের নতুন রূপে বিস্ফোরিত হয়।
বাংলাবার্তা/এসজে