
ছবি: সংগৃহীত
কর ব্যবস্থায় দীর্ঘদিনের বৈষম্য ও জটিলতা দূর করতে সরকার এবার এক যুগান্তকারী সংস্কারের পথে হাঁটছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কর কাঠামোতে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে, যার আওতায় এখন থেকে ‘প্রকৃত করের’ ওপরই সরাসরি সারচার্জ আরোপ করা হবে। এতদিন সারচার্জ আরোপ করা হতো অগ্রিম আয়করসহ মোট পরিশোধিত টাকার ওপর, যা কার্যত করদাতাদের জন্য ছিল একটি আর্থিক ফাঁদ।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই সংস্কার বাস্তবায়িত হলে কর কাঠামো আরও স্বচ্ছ ও ন্যায্য হবে। উচ্চ আয়ের করদাতারা, বিশেষ করে আমদানিকারকরা, দীর্ঘদিন ধরেই অযৌক্তিকভাবে অতিরিক্ত সারচার্জ দিয়ে আসছিলেন, যা এবার থেকে অনেকটাই লাঘব পাবে।
বর্তমানে ব্যক্তি খাতের অনেক আমদানিকারককে আমদানির সময় অগ্রিম আয়কর (Advance Income Tax - AIT) দিতে হয়, যেটি পরবর্তীতে মূল কর হিসেবে গণ্য হয় না। বছরের শেষে দেখা যায়, একজন করদাতার প্রকৃত করযোগ্য আয় ধরা হয় অনেক কম, কিন্তু তার কাছ থেকে যে পরিমাণ অগ্রিম কর কেটে নেওয়া হয়েছিল, সেটিই সারচার্জ হিসেব করার ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়।
উদাহরণস্বরূপ, একজন আমদানিকারকের প্রকৃত করযোগ্য আয় অনুযায়ী তাকে হয়তো ৫০ টাকা কর দিতে হতো। কিন্তু আমদানি পর্যায়ে তার কাছ থেকে ১০০ টাকা কেটে নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে ৪ কোটি টাকার বেশি সম্পদ থাকলে ১০ থেকে ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত সারচার্জ বসে সেই ১০০ টাকার ওপর, অর্থাৎ ৩৫ টাকা। অথচ প্রকৃত কর ৫০ টাকা হলে সারচার্জ হতো মাত্র ১৭.৫ টাকা। এই বৈষম্য বহুদিন ধরেই করদাতাদের ক্ষোভের কারণ হয়ে উঠেছিল।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, নাম প্রকাশ না করার শর্তে, জানান, ‘আমরা বর্তমানে এমন একটি পদ্ধতি চালু রাখছি যেখানে অগ্রিম কাটা করের পূর্ণ পরিমাণকেই প্রকৃত কর ধরা হচ্ছে না, তবুও সেই অঙ্ককে ভিত্তি করে সারচার্জ বসছে। এটা নিঃসন্দেহে অযৌক্তিক। আমরা এখন এমন একটি ব্যবস্থা আনতে যাচ্ছি যেখানে কেবলমাত্র প্রকৃত করযোগ্য আয় অনুযায়ী হিসাব করেই সারচার্জ ধার্য হবে।’
তিনি বলেন, এই পরিবর্তনের ফলে করদাতারা প্রকৃত আয়ের তথ্য প্রকাশে আরও আগ্রহী হবেন এবং আয়ের গোপনীয়তা হ্রাস পাবে।
স্নেহাশীষ মাহমুদ অ্যান্ড কোম্পানির কর বিশেষজ্ঞ ও ম্যানেজিং পার্টনার স্নেহাশীষ বড়ুয়া বলেন, “বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রেই উৎসে কর (Withholding Tax) ও সংগ্রহকৃত কর (Collected Tax) বাস্তবে ন্যূনতম কর হিসেবে গণ্য হয়, যার ফলে করদাতার কার্যকর করহার (Effective Tax Rate) অনেক বেশি হয়ে পড়ে। তার ওপর আবার সারচার্জ আরোপ করা হলে তা এক ধরনের দ্বৈত শাস্তি হিসেবে দাঁড়ায়।”
তিনি বলেন, “প্রকৃত করের ওপর সারচার্জ বসানোর উদ্যোগ প্রশংসনীয়। তবে প্রকৃত স্বস্তি পেতে হলে উৎসে কর কর্তনের হার যৌক্তিকভাবে সমন্বয় করতে হবে। এতে করে অতিরিক্ত কর কেটে রাখার প্রবণতা কমবে এবং করদাতারাও আত্মবিশ্বাস নিয়ে সম্পদের হিসাব দেবেন।”
এফবিসিসিআই-এর সাবেক সহসভাপতি ও ট্যাক্স পলিসি বিশ্লেষক মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, “বর্তমান পদ্ধতিতে কর রিটার্নে বাস্তব আয় বা সম্পদের তথ্য দিলে করদাতারা বাড়তি চাপের মধ্যে পড়ে যান। এতে অনেকেই হয় ভুল তথ্য দেন, নয়তো রিটার্ন জমা না দেওয়ার দিকে ঝুঁকেন। এই সংস্কারটি কার্যকর হলে কর সংস্কৃতি আরও ইতিবাচক হবে।”
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক রাশেদুল হক বলেন, “আমদানি পর্যায়ে অতিরিক্ত কর কর্তনের বিষয়টি আমাদের সদস্যদের বড় এক উদ্বেগ। তার ওপর সারচার্জ আরোপ ব্যবসা পরিচালনায় বাড়তি প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। এই সংস্কার যদি বাজেট ঘোষণায় আনুষ্ঠানিকভাবে আসে, তাহলে তা নিঃসন্দেহে ব্যবসাবান্ধব পদক্ষেপ হবে।”
বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, শুধু সারচার্জ বিধান সংস্কার নয়, বরং সার্বিকভাবে অগ্রিম কর ও রিফান্ড পদ্ধতিকে আধুনিক ও কার্যকর করা দরকার। অধিকাংশ দেশে করদাতার কাছ থেকে বাড়তি কর কাটা হলে, তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফেরত দেওয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এই ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় ভরা।
অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, “রিফান্ড ব্যবস্থার সংস্কার সময়ের দাবি। করদাতাকে উৎসাহিত করতে হলে শুধু করের হার বা বিধান বদলানো যথেষ্ট নয়, বরং সেবা পাওয়ার সহজলভ্যতাও নিশ্চিত করতে হবে। এতে রাজস্ব বাড়বে এবং করজালের বাইরে থাকা অনেকে স্বেচ্ছায় করজালে আসবেন।”
সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী ২ জুন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার সময় অর্থ উপদেষ্টা এই নতুন সারচার্জ নীতির কথা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করবেন বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। এটি অর্থ অধ্যাদেশের অংশ হিসেবেই কার্যকর হবে।
বাংলাদেশের কর কাঠামো দীর্ঘদিন ধরে নানা বৈষম্য, জটিলতা ও অনুৎসাহের মধ্য দিয়ে চলেছে। সারচার্জ ব্যবস্থার এই সংস্কার যদি বাস্তবায়িত হয়, তবে এটি শুধু উচ্চ আয়ের করদাতাদের জন্য নয়, বরং দেশের সামগ্রিক রাজস্ব ব্যবস্থার স্বচ্ছতা, ন্যায্যতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে। এখন দেখার বিষয়—এই সংস্কার কত দ্রুত ও কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন হয়।
বাংলাবার্তা/এসজে