
ছবি: সংগৃহীত
রাজধানীর প্রশাসনিক প্রাণকেন্দ্র সচিবালয় চতুর্থ দিনের মতো কেঁপে উঠেছে হাজার হাজার সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিক্ষোভে। "অবৈধ কালো আইন মানি না, মানবো না", "লড়াই লড়াই লড়াই চাই, ১৮ লাখ কর্মচারীর অধিকার চাই"—এমন শত সহস্র প্রতিবাদী স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠেছে সচিবালয়ের প্রতিটি অলিগলি। সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫ বাতিলের দাবিতে এই আন্দোলন ক্রমেই এক সর্বাত্মক প্রশাসনিক বিদ্রোহের রূপ নিচ্ছে।
মঙ্গলবার (২৭ মে) সকাল ১১টার দিকে সচিবালয়ের ৬ নম্বর ভবনের পাশে বাদামতলা চত্বরে জড়ো হয়ে আন্দোলন শুরু করেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। মিছিলটি দ্রুত সচিবালয়ের বিভিন্ন ভবনের সামনে ছড়িয়ে পড়ে। মুখে মুখে ফেরে একটাই বার্তা—“অবৈধ কালো আইন, বাতিল কর করতে হবে!” আন্দোলনকারীরা বারবার এই অধ্যাদেশকে 'গণবিরোধী', 'স্বেচ্ছাচারী' এবং 'নির্বিচার ছাঁটাইয়ের হাতিয়ার' হিসেবে আখ্যা দিচ্ছেন।
তারা বলছেন, এই আইন কার্যকর হলে ‘সাধারণ কারণ দর্শানো নোটিশেই’ চাকরিচ্যুতি সম্ভব হবে, যা সরকারি চাকরির দীর্ঘদিনের স্থায়িত্ব, ন্যায্য শুনানি এবং প্রশাসনিক নিরাপত্তা সংস্কৃতিকে ধ্বংস করবে।
বিক্ষোভকারীদের হাতে প্ল্যাকার্ড, পোস্টার, ব্যানার—তাতে লেখা বিভিন্ন প্রতিবাদী বার্তা। মুখে মুখে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে স্লোগান—
“লেগেছে রে লেগেছে, রক্তে আগুন লেগেছে”
“অবৈধ কালো আইন মানি না, মানবো না”
“এক হও, লড়াই করো, ১৮ লাখ কর্মচারী”
“সচিবালয়ের কর্মচারী, এক হও এক হও”
“আপস না, সংগ্রাম—সংগ্রাম সংগ্রাম!”
এগুলো শুধু কথার আওয়াজ নয়, বরং অসন্তোষের সুনামি, যেটি সরকারের নেওয়া বিতর্কিত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিস্ফোরণের পথে।
যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী এখনো বিক্ষোভে সরাসরি অংশ নেননি, তাদের অনেকেই সহকর্মীরা আহ্বান জানাচ্ছেন আন্দোলনে যোগ দেওয়ার জন্য। সচিবালয়ের করিডোরে করিডোরে, দপ্তর থেকে দপ্তরে গিয়ে আন্দোলনের সমর্থনে প্রচার চালানো হচ্ছে। এক কর্মচারী বলেন, “এই আইন আমাদের সবাইকে ঝুঁকিতে ফেলেছে। আজ না জাগলে কাল হয়তো চাকরিই থাকবে না।”
চলমান আন্দোলনের প্রেক্ষিতে সচিবালয়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থা বহুগুণে জোরদার করা হয়েছে। আজ থেকে বহিরাগত দর্শনার্থীদের সচিবালয়ে প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রতিটি প্রবেশপথে অতিরিক্ত পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। কোনো কোনো গেটে ভেতরে সাংবাদিকদেরও ঢুকতে দেওয়া হয়নি। সচিবালয়ের ভেতরের পুরো পরিবেশকে প্রায় ‘আংশিক অবরুদ্ধ এলাকা’ বললেও অত্যুক্তি হয় না।
একজন নিরাপত্তাকর্মী জানান, “উর্ধ্বতন নির্দেশে সচিবালয়ের সকল গেটে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। কোনো অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি এড়াতেই এমন ব্যবস্থা।”
মূল বিতর্ক কেন্দ্র করে রয়েছে ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’, যেটি গত রোববার (২৫ মে) সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের পর জারি হয়। এই অধ্যাদেশ অনুযায়ী, চার ধরনের শৃঙ্খলাভঙ্গের অপরাধে বিভাগীয় মামলার প্রয়োজন ছাড়াই শুধু একটি কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েই একজন সরকারি কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করা যাবে। এই বিধানকে সরকারি কর্মচারীরা অযৌক্তিক, স্বেচ্ছাচারী ও মানবাধিকার পরিপন্থী হিসেবে অভিহিত করেছেন।
অধ্যাদেশটির খসড়া প্রথমে গত ২২ মে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের সভায় অনুমোদিত হয়। এরপর থেকেই ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে সচিবালয়ের অভ্যন্তরে। আন্দোলন শুরু হয় শনিবার (২৪ মে) থেকেই, যা পরদিন রোববার এবং সোমবার আরও ব্যাপক রূপ নেয়। প্রায় সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী সংগঠন একত্রিত হয়ে এই অধ্যাদেশ প্রত্যাহারের দাবি জানায়।
কর্মচারীদের একাধিক সংগঠনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, যতক্ষণ না বিতর্কিত অধ্যাদেশটি সম্পূর্ণভাবে বাতিল করা হচ্ছে, ততক্ষণ তারা রাজপথ ছাড়বে না এবং সচিবালয়ের বিক্ষোভ চলতেই থাকবে। আন্দোলনকারীদের মতে, এটি শুধু সচিবালয়ের কর্মচারীদের নয়—১৮ লাখ সরকারি চাকরিজীবীর অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই।
এক আন্দোলনকারী কর্মকর্তার ভাষায়, “আমরা শুধু নিজেদের জন্য দাঁড়াইনি, পুরো সরকারি ব্যবস্থাকে রক্ষা করতেই রাস্তায় নেমেছি। আজ যদি চুপ থাকি, কাল আর কারও চাকরি নিরাপদ থাকবে না।”
এই আন্দোলন এখন শুধুই একটি 'অধ্যাদেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ' নয়—বরং এটি রূপ নিচ্ছে প্রশাসনিক ন্যায়বিচার, সরকারি চাকরির স্থিতিশীলতা এবং কর্মচারীদের অধিকার রক্ষার বৃহত্তর আন্দোলনে। সরকারের জন্য এটি এখন এক কঠিন চ্যালেঞ্জ—একদিকে প্রশাসনিক কর্তৃত্ব, অন্যদিকে গণআকাঙ্ক্ষা এবং চাকরিজীবীদের বৃহৎ স্বার্থ। ভবিষ্যতে এই সংঘাত কোন দিকে গড়ায়, তার দিকেই এখন তাকিয়ে দেশজুড়ে লাখো সরকারি কর্মচারী এবং সচেতন নাগরিক সমাজ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ