
ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক পুনর্গঠনের কূটনৈতিক প্রয়াসের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের সরকার আসন্ন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে আমদানি পণ্যের ওপর শুল্কহার হ্রাসের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে অন্তত ১০০ ধরনের পণ্যের ওপর আমদানি শুল্ক কমানো হচ্ছে, যেগুলোর বেশিরভাগই যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি হয়। মূল উদ্দেশ্য—বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাস ও বাংলাদেশের তৈরি পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ থেকে মুক্তি পাওয়ার কৌশলগত পথ সুগম করা।
বিষয়টি উঠে আসে সোমবার (১৯ মে) রাতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও সরকারের শীর্ষ অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারকদের মধ্যে অনুষ্ঠিত এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে। যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারি বাসভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদ, এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান, এনবিআরের আয়কর, ভ্যাট ও শুল্ক বিভাগের সদস্য, প্রথম সচিব ও দ্বিতীয় সচিবসহ অন্যান্য শীর্ষ কর্মকর্তা।
বৈঠকে এনবিআর যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানিকৃত পণ্যের ওপর অন্তত ১০০টি ট্যারিফ লাইনের শুল্ক শূন্য করার প্রস্তাব দেয়। প্রাথমিকভাবে প্রধান উপদেষ্টা এ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন—শুধু যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এ ধরনের সুবিধা কীভাবে দেওয়া সম্ভব? জবাবে এনবিআর জানায়, এই সব পণ্যে শুল্ক ছাড় দিলে যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে, কারণ এসব পণ্যের একটি বড় অংশ তাদের থেকেই আসে এবং তা সরকারি আমদানি প্রকল্পের মাধ্যমেই ব্যবহৃত হয়।
প্রস্তাবিত শুল্কমুক্ত ১০০ পণ্যের তালিকায় রয়েছে জ্বালানি, অস্ত্র, ফাইটার বিমানের যন্ত্রাংশ, মিসাইলসহ বেশ কিছু কৌশলগত সরকারি কেনাকাটার পণ্য। যেহেতু এসব পণ্য সরকার কিনে এবং কেনাকাটার সময় দ্বিপক্ষীয় বা আন্তর্জাতিক চুক্তির আওতায় থাকে, তাই শুল্ক ছাড় দিলেও রাজস্ব হারানোর ঝুঁকি থাকছে না বলেই এনবিআরের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
তেল ও গ্যাসসহ বেশ কিছু প্রযুক্তি-নির্ভর পণ্য এবং মিলিটারি কম্পোনেন্ট যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরকারের প্রতিরক্ষা ও জ্বালানি খাতে চলমান এবং ভবিষ্যৎ চুক্তির আওতায় আমদানি হবে বলে ধারণা। এসব ক্ষেত্রেই শুল্ক ছাড় কার্যকর হলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সরকারি পর্যায়ের বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাস পাবে বলে মনে করছে অর্থ মন্ত্রণালয় ও এনবিআর।
বাংলাদেশের তৈরি পণ্য, বিশেষত তৈরি পোশাক, যুক্তরাষ্ট্রে দীর্ঘদিন ধরেই ১৫ শতাংশ শুল্কের মুখে ছিল। কিন্তু চলতি বছর এপ্রিল থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন শতাধিক দেশের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে। ফলে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর সর্বমোট শুল্ক বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৫২ শতাংশ। এতে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়ে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে বছরে প্রায় ৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে, এর বিপরীতে আমদানি করে ২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। ফলে বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্র একটি বিশাল রপ্তানি বাজার হলেও বাণিজ্য ঘাটতি যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
এমন পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস স্বয়ং ডোনাল্ড ট্রাম্পকে একটি চিঠি পাঠান, যেখানে তিনি বাংলাদেশের অর্থনীতি ও শ্রমঘন খাতের ওপর শুল্কারোপের নেতিবাচক প্রভাব তুলে ধরেন এবং অন্তত তিন মাসের জন্য সম্পূরক শুল্কের সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখার অনুরোধ জানান।
চিঠিতে আরও জানানো হয় যে, বাংলাদেশ বাণিজ্য বৈষম্য কমাতে ইতোমধ্যেই ১৯০ ধরনের মার্কিন পণ্যের ওপর শুল্ক শূন্য করেছে এবং আরও ১০০ পণ্যের ওপর একই রকম ছাড় দেওয়ার প্রতিশ্রুতি রয়েছে, যা খুব শিগগির কার্যকর করা হবে।
বৈঠকে শুধু শুল্ক নয়, ব্যক্তি শ্রেণির আয়কর কাঠামো নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনায় এমন করপদ্ধতি গ্রহণের কথা বলা হয়, যাতে রাজস্ব আদায়ে খুব বেশি ক্ষতি না হয়, আবার সাধারণ মানুষের ওপরও অতিরিক্ত চাপ না পড়ে।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ব্যক্তির করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো হচ্ছে এবং সর্বনিম্ন কর নির্ধারণ করা হচ্ছে ৫ হাজার টাকা। অপরদিকে সর্বোচ্চ করহার বাড়িয়ে ৩০ শতাংশে উন্নীত করার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে করপোরেট করহারে পরিবর্তন না আনলেও কিছু শর্ত শিথিল করার মাধ্যমে কর প্রদান প্রক্রিয়া সহজ করার সুপারিশ গৃহীত হয়েছে।
এছাড়া রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যক্তিরা মৎস্য, ডেইরি ও পোলট্রি খাতে বিনিয়োগ দেখিয়ে আগে যে কর ছাড় পেতেন, সেই সুবিধা তুলে নেওয়ার প্রস্তাবকেও নীতিগতভাবে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের এই শুল্ক ছাড়ের কৌশল আন্তর্জাতিক বাণিজ্য রাজনীতির এক নিখুঁত চাল বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর অবস্থান সাময়িকভাবে স্থগিত রাখতে এবং বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাতগুলোকে রক্ষা করতে এটি একটি সুপরিকল্পিত কৌশল।
এই উদ্যোগের মধ্য দিয়ে শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, অন্যান্য বাণিজ্য অংশীদার দেশগুলোর কাছেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কূটনীতি ও প্রস্তুতির বার্তা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। যুক্তরাষ্ট্রের চাপ হালকাকরণ, ট্রাম্প প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে প্রভাব বিস্তার এবং রপ্তানির ধারাবাহিকতা রক্ষা করতেই এমন উদ্যোগ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
তাদের মতে, এই ধরনের সুনির্দিষ্ট ও সময়োপযোগী উদ্যোগই ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আরও প্রতিযোগিতামূলক এবং বহুজাতিক বাণিজ্যের মূলধারায় ধরে রাখতে সাহায্য করবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ