
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশে পণ্য আমদানির নীতি দীর্ঘদিন ধরেই নানা ধরনের শর্ত, ন্যূনতম দর বা নগদ মার্জিনের বাধ্যবাধকতার কারণে জটিল হয়ে উঠেছিল। এবার সেই জটিলতার অবসান ঘটতে যাচ্ছে। নতুন আমদানি নীতি আদেশ (২০২৫-২০২৮)-এ ঋণপত্র (এলসি) খোলার ক্ষেত্রে কোনো প্রকার বাধ্যবাধকতা থাকছে না। অর্থাৎ, যেকোনো আমদানিকারক এখন থেকে যেকোনো পরিমাণ পণ্য সহজেই আমদানি করতে পারবেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যে নতুন নীতির খসড়া প্রস্তুত করেছে, যেখানে ন্যূনতম দর ও নগদ মার্জিনের বাধ্যবাধকতা পুরোপুরি বাতিল করার প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে মূলত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) নিয়মের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে। ডব্লিউটিওর শর্ত অনুযায়ী, কোনো দেশ তাদের আমদানিকারকদের ওপর এমন আর্থিক বাধ্যবাধকতা চাপাতে পারবে না, যা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার পরিবেশের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও বহু বছর ধরে আমদানিকারক মহল থেকে অভিযোগ ছিল, এলসি খোলার ক্ষেত্রে ন্যূনতম দর ও নগদ মার্জিন আমদানিকে অকারণে ব্যয়বহুল করে তুলছে। এবার সেই অভিযোগের সমাধান মিলছে।
বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান জানিয়েছেন, আগামী সপ্তাহের শুরুতেই খসড়ার মূল বিষয়গুলো বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের কাছে উপস্থাপন করা হবে। এরপর উপদেষ্টার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী সংশোধন করে নীতির খসড়া চূড়ান্ত করা হবে। পরে তা অনুমোদনের জন্য উপদেষ্টা পরিষদে পাঠানো হবে। অনুমোদন প্রক্রিয়া শেষ হলে আনুষ্ঠানিকভাবে ২০২৫-২০২৮ মেয়াদের আমদানি নীতি কার্যকর হবে।
বর্তমান আমদানি নীতি (২০২১-২০২৪) এর মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২৪ সালের জুনে। নতুন নীতি জারি না হওয়া পর্যন্ত পুরোনো নীতি কার্যকর থাকছে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, আগের নীতিও দেরিতে জারি হয়েছিল—২০১৫-১৮ নীতি শেষ হওয়ার প্রায় সাড়ে চার বছর পর, অর্থাৎ ২০২২ সালের মে মাসে নতুন আদেশ জারি করা হয়েছিল।
বাংলাদেশ মাত্র ১৪ মাস পর স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হয়ে আসছে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে আমদানিনীতিকে আরও উদার করতে হচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, নতুন তিন বছরের আমদানি নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।
শুধু এলসি সহজীকরণ নয়, নতুন নীতি খসড়ায় পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য রক্ষায় বেশ কিছু বিধানও যোগ করা হয়েছে।
-
হাইড্রোলিক হর্ন নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে।
-
শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য হর্নের শব্দমাত্রা সর্বোচ্চ ১০০ ডেসিবেলে সীমাবদ্ধ করার সুপারিশ করা হয়েছে।
-
খাদ্যদ্রব্য আমদানির ক্ষেত্রে সরকার অনুমোদিত গবেষণাগারের তালিকা প্রযোজ্য হবে।
-
মানুষের খাদ্যের মান যাচাইয়ের জন্য অভিন্ন মানদণ্ড চালু করার সিদ্ধান্তও খসড়ায় রয়েছে।
প্রথমবারের মতো পেট্রোকেমিক্যাল শিল্পের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল ইথাইলিন ও প্রোপাইলিন আমদানির অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। তবে এ ধরনের পণ্য আনতে হলে বিস্ফোরক পরিদপ্তর ও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের অনুমতি নিতে হবে।
বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের বাজারে কিছু জটিলতা তৈরি হয়েছিল আমদানিনিষিদ্ধ পণ্যের কারণে। উদাহরণস্বরূপ, মিথাইল ব্রোমাইড ব্যবহার নিষিদ্ধ থাকায় অস্ট্রেলিয়ায় চাল ও মসলা রপ্তানি জটিল হয়ে উঠেছে। এ ছাড়া পুরোনো ব্যাটারি আমদানির অনুমতি, গ্যাস সিলিন্ডারের আলাদা এইচএস কোড ব্যবহার, ব্যাটারি পরিবেশবান্ধবভাবে রিসাইক্লিং ইত্যাদি বিষয়ে অস্পষ্টতা ছিল। নতুন নীতিতে এসব সমস্যার সমাধান আনার চেষ্টা করা হচ্ছে।
খসড়ায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, কিছু পণ্য সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকবে। এর মধ্যে রয়েছে—
-
সব ধরনের বর্জ্য পদার্থ,
-
চিংড়ি, জীবিত শূকর ও শূকরজাত পণ্য,
-
পপি বীজ ও পোস্তদানা,
-
ঘাস ও ঘন চিনি,
-
কৃত্রিম সরিষার তেল,
-
রিকন্ডিশন্ড অফিস সরঞ্জাম যেমন টাইপরাইটার, টেলেক্স, ফোন, ফ্যাক্স, পুরোনো কম্পিউটার ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক সামগ্রী,
-
হাইড্রোলিক হর্ন ও ৭৫ ডেসিবেলের বেশি শব্দযুক্ত সব হর্ন,
-
বিভিন্ন ক্ষতিকর রাসায়নিক কীটনাশক ও শিল্পজাত দ্রব্য,
-
পলি প্রোপাইলিন ও পলিথিন ব্যাগ,
-
দুই স্ট্রোক ইঞ্জিন ও চেসিসবিশিষ্ট থ্রি-হুইলার যানবাহন।
এছাড়া বাংলাদেশের সীমারেখা ছাড়া মানচিত্র, অশ্লীল বা নাশকতামূলক সাহিত্য, হরর কমিকস ও উপমহাদেশীয় ভাষার চলচ্চিত্র (যৌথ প্রযোজনা ছাড়া) আমদানি করা যাবে না।
কিছু পণ্য শর্তসাপেক্ষে আমদানি করা যাবে। যেমন—
-
সাড়ে ৪ সেন্টিমিটারের কম ব্যাস বা দৈর্ঘ্যের মাছ ধরার কারেন্ট জাল,
-
পাঁচ বছরের বেশি পুরোনো গাড়ি,
-
তিন বছরের বেশি পুরোনো এবং ১৬৫ সিসির বেশি মোটরসাইকেল,
-
এলএনজি,
-
প্লাস্টিকের খেলনা, যেখানে রপ্তানিকারক দেশ থেকে স্বাস্থ্যঝুঁকি না থাকার সনদ থাকতে হবে।
এ ছাড়া বেসামরিক বিমান বা হেলিকপ্টার আমদানিও শর্তসাপেক্ষে অনুমোদিত হবে। পুরোনো জাহাজ আমদানির ক্ষেত্রে আমদানিকারক ও রপ্তানিকারকের পক্ষ থেকে বিষাক্ত বর্জ্য না থাকার নিশ্চয়তাপত্র থাকতে হবে।
উপমহাদেশীয় ভাষার চলচ্চিত্র বাংলাদেশে আমদানি করা যাবে না, তবে যৌথ প্রযোজনার সিনেমা আমদানির অনুমতি থাকবে। আবার বাংলাদেশ থেকে যেসব চলচ্চিত্র সাফটাভুক্ত দেশে রপ্তানি হবে, তার সমসংখ্যক চলচ্চিত্র আমদানির সুযোগ মিলবে তথ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, এলসি খোলার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হলে ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকদের জন্য বাজার অনেকটা উন্মুক্ত হয়ে যাবে। এতে প্রতিযোগিতা বাড়বে, বাজারে বৈচিত্র্যময় পণ্যের প্রাপ্যতা নিশ্চিত হবে, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে মূল্যও কমতে পারে। তবে এর সঙ্গে সঙ্গে দেশীয় শিল্পকে রক্ষা করার জন্য সঠিক শুল্কনীতি ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা না থাকলে চ্যালেঞ্জ তৈরি হতে পারে।
সামগ্রিকভাবে নতুন আমদানি নীতি আদেশ বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যবস্থাকে আধুনিক, উদার এবং পরিবেশবান্ধব করার একটি বড় পদক্ষেপ। এলসি খোলার ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা তুলে নেওয়া যেমন ব্যবসা সহজ করবে, তেমনি পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ পণ্য আমদানির বিধান সাধারণ মানুষের জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে নীতি অনুমোদন ও বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশ আমদানিবান্ধব অর্থনীতির দিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবে।
বাংলাবার্তা/এসজে