ছবি : সংগৃহীত
দেশের উন্নতির পেছনে একমাত্রা বাধা হল দুর্নীতি। যেদেশে যত দুর্নীতি কম সে দেশ তত উন্নতি। দেশের বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে এখনি সময় এই সিস্টেমটাকে সংস্কার করে জিরো টলারেন্স নীতি সঠিকভাবে কার্যকর করা।
দুর্নীতির যে বিস্তার আমরা দেখছি, তাতে স্পষ্ট যে, জিরো টলারেন্স নীতি সঠিকভাবে কার্যকর হয়নি বিগত সময়ে। দেশের অর্থনীতি ভয়াবহ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কারণ হাজার হাজার কোটি টাকা প্রতারণার মাধ্যমে অন্য দেশে পাচার করা হচ্ছে। ভাগ্য আমাদের, এত দুর্নীতি করার পরও দেশটা টিকে আছে। গণমাধ্যম থেকে জানতে পারি, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকারি কর্মকর্তারা কানাডার টরন্টোসহ বিভিন্ন দেশে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করেছেন, যা রাজনীতিবিদদের চেয়েও বেশি। সম্প্রতি অনেক বড় বড় আমলা এবং পুলিশের বড় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিস্তর দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ পায়। এদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। বর্তমান সরকারকে কঠোর উদ্যোগ বা সংস্কার করতে হবে, যাতে আর কোনো দুর্নীতিবাজ রাজনীতি করার সাহস না পায়। সংস্কারের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ এবং সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হোক। বর্তমানে যেন কোনো দুর্নীতি না হয়, সে বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে।
অসাধু রাজনীতিবিদ, দুর্নীতিবাজ কিছু সরকারি কর্মকর্তা এবং লোভী ব্যবসায়ীরা বিশ্বব্যাপী নিরাপদ গন্তব্যগুলোতে প্রচুর অর্থ পাচার করছে। ফলে তারা পরিবারের সুরক্ষিত ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে বিদেশে তাদের প্রশ্নবিদ্ধ সম্পদ বিনিয়োগ করে যাচ্ছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। অতীতে দুর্নীতি প্রসঙ্গে সরকার ২৮টি মামলা করেছিল; যার মধ্যে রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী রয়েছে। এসব মামলার ফলাফল কী? জনগণের সামনে তা প্রকাশ করা উচিত। এতে বর্তমান সরকারের স্বচ্ছতা বাড়বে।
অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি ব্যাংক এবং নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (এনবিএফআই) উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। পি কে হালদার একাই কানাডায় ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা পাচার করেছেন, যা তিনি চারটি এনবিএফআই থেকে ঋণ হিসেবে নিয়েছিলেন। তিনিও গোপনে দেশ ত্যাগ করেন। এ ছাড়া মতিউর ও বেনজীরের কত টাকা বিদেশে আছে, তা তদন্ত করা দরকার। দেশের আজকের অর্থনৈতিক সংকটের মূলে রয়েছে এসব অর্থ পাচার।
গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, প্রতিবছর যে ভয়াবহ আকারে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার হচ্ছে, এভাবে চলতে থাকলে ২০৩০ সালে এটি ১৪ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অর্থ পাচারের এই প্রবণতা ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি সফলভাবে বাস্তবায়নে বাংলাদেশের ক্ষমতাকে উল্লেখযোগ্যভাবে বাধাগ্রস্ত করবে। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির তথ্য অনুযায়ী, এখান থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ পর্যন্ত পাচার হয়েছে ১১ লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকা।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) ২০২৩ সালের ‘দুর্নীতির ধারণা সূচক’-এ বিশ্বের দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশ দুই ধাপ এগিয়েছে। এবার বাংলাদেশের অবস্থান দশম, যা গতবার ছিল দ্বাদশ। গত এক যুগের মধ্যে বাংলাদেশে দুর্নীতি এবার সবচেয়ে বেশি। আমাদের জন্য এটি ইতিবাচক নয়। বিশ্বের কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় আগের বছর বাংলাদেশ ১৪৯তম হলেও এ বছর হয়েছে ১৪৭তম। দুর্নীতি আমাদের সমাজের জন্য বড় বাধা; যা দেশ বা জাতিকে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। আমাদের উন্নয়ন বিঘ্নিত করছে।
বিভিন্ন সেবা পেতে যেমন–ভূমির দলিল নিবন্ধন সেবায় সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়টি অনেকটা ওপেন সিক্রেট। দুর্নীতি দমন কমিশনও অতীতে সরকারি ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসগুলোতে দুর্নীতির নানা উৎস চিহ্নিত করেছে। কিন্তু এরপরও অনিয়ম-দুর্নীতির রাশ টানা সম্ভব হয়নি। যাতে লাভবান হচ্ছেন ক্রেতা ও সাব-রেজিস্ট্রার। দুর্নীতি আমাদের জীবনে একটি কালো অধ্যায়। তাই দুর্নীতি বন্ধে জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল সংক্রান্ত কর্মপরিকল্পনা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হওয়া একান্ত প্রয়োজন। তবে দুর্নীতি কমাতে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে, যেমন–যেসব কর্মকর্তা সততা এবং ন্যায়-নীতি নিয়ে কাজ করবেন তাদের আর্থিক প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে। সব পর্যায়ে নীতিবান কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে পুরস্কারের ব্যবস্থা করতে হবে, যা দুর্নীতি রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
সব দেশে দুর্নীতি কম-বেশি হয়, তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভিন্ন। কারণ এখানে দুর্নীতির গভীরতা ও ব্যাপকতা এমন পর্যায়ে গেছে, যা কমাতে শুধু আইন করলে হবে না, দরকার বাস্তব প্রয়োগ এবং বিচার হতে হবে দৃষ্টান্তমূলক। দুর্নীতির সঙ্গে যে বা যারা জড়িত, তাদের তদন্ত করে বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। দেশের বিভিন্ন খাতে যে অতুলনীয় অর্থনৈতিক সম্ভাবনা রয়েছে, তা দুর্নীতির জন্য আমরা অর্জন করতে পারছি না। তাই দুর্নীতির মূল বিনষ্ট করতে না পারলে দেশ অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়বে। আমাদের সবার উচিত দুর্নীতিকে না বলা এবং দুর্নীতির রোধে ব্যাপকভাবে সোচ্চার হওয়া।
ড. মো. শফিকুল ইসলাম: সহযোগী অধ্যাপক, হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য পদ্ধতি বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।
বাংলাবার্তা/এআর