
ছবি: সংগৃহীত
অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরেরও বেশি সময় পার হলেও দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে আস্থা, স্বস্তি কিংবা স্থিতিশীলতা ফিরেনি—এমন অভিযোগ করছেন শীর্ষ ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা। বরং তাঁদের মতে, ব্যবসায়ীরা এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি অনিরাপদ, অনিশ্চিত এবং বৈষম্যের শিকার। সরকারের কাঙ্ক্ষিত মনোযোগ না পেয়ে তাঁরা কার্যত দম বন্ধ পরিস্থিতির মুখোমুখি।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত বছরের ৫ আগস্টের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সময় তাঁদের মধ্যে ব্যাপক আশা তৈরি হয়েছিল। অনেকেই ভেবেছিলেন—দুর্নীতি, লুটপাট ও স্বজনপ্রীতির রাজনীতি থেকে বের হয়ে একটি ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরি হবে। কিন্তু বাস্তব চিত্র উল্টো।
-
শীর্ষ ব্যবসায়ী গ্রুপগুলোর বিরুদ্ধে ‘মিডিয়া ট্রায়াল’ চালানো হয়েছে।
-
মিথ্যা মামলা, বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা এবং নির্বিচারে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করে রাখা হয়েছে।
-
অপরাধ প্রমাণ হওয়ার আগেই তাঁদের হয়রানি করা হয়েছে।
-
কিছু শিল্পগোষ্ঠীর কার্যক্রম হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়ায় হাজার হাজার শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন।
-
বিদেশি বায়ারদের সঙ্গে নির্ধারিত ব্যবসায়িক বৈঠক করতে না পারায় বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা বাণিজ্যে বড় ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন,
“২০২৫ সালে শুধু শিল্প নয়, উদ্যোক্তাদেরও প systematically মেরে ফেলা হচ্ছে। শিল্প বাঁচাতে না পারলে দেশে দুর্ভিক্ষ হবে। গ্যাসসংকট আর চলতি মূলধনের অভাবে প্রতিনিয়ত কারখানা লে-অফ হচ্ছে। এই পরিস্থিতি আর বেশি দিন টিকবে না—মানুষ খুব শিগগিরই রাস্তায় নামবে।”
বিনিয়োগে মন্দা এতটাই গভীর যে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না। বরং প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ চাকরি হারাচ্ছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে—দেশে সরকারি চাকরির অংশ মাত্র ৩.৮ শতাংশ, যেখানে বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থান নির্ভর করছে ১৪.২ শতাংশের ওপর। সবচেয়ে বড় অংশ—৬১ শতাংশ—নির্ভর করছে ব্যক্তি উদ্যোগের ওপর। অর্থাৎ ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হলে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কোটি কোটি মানুষ।
বিশ্বব্যাংকের ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৫ সালে নতুন করে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যেতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্যবসা ও বিনিয়োগ থমকে যাওয়ায় এই আশঙ্কা বাস্তবে পরিণত হচ্ছে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের সাময়িক হিসাবে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩.৯৭ শতাংশ, যা আগের বছরের ৪.২২ শতাংশ থেকেও কম। একই সময়ে বেসরকারি বিনিয়োগ কমে জিডিপির ২২.৪৮ শতাংশে নেমেছে, যা আগের বছর ছিল ২৩.৫১ শতাংশ।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী বলেন, “আইন-শৃঙ্খলার উন্নতি হয়নি, জ্বালানি সমস্যা সমাধান হয়নি। সুদের হার বাড়িয়ে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা সরকারের কাছ থেকে যে সহযোগিতা আশা করেছিলেন, তা পাননি। ফলে আস্থাহীনতা অর্থনীতিকে পিছিয়ে দিচ্ছে।”
ব্যবসায়ীরা মনে করেন, সরকারকে ভুল পথে চালিত করছে একটি স্বার্থান্বেষী মহল। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে শীর্ষ শিল্পগ্রুপগুলোকে ‘বলির পাঁঠা’ বানিয়ে দেশের উৎপাদন ও বাণিজ্যকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. আমিরুল হক বলেন,
“দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বড় পরিবর্তন এসেছিল। এখন সেই বিপ্লবী সরকারের অধীনে ব্যবসায়ীরা জেল-জুলুমের শিকার হচ্ছেন। স্থিতিশীল পরিবেশ নেই, দীর্ঘমেয়াদি করনীতি নেই, সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্ব্যবহার আছে। ব্যবসায়ীদের সম্মান দেওয়া হচ্ছে না। নির্বাচিত সরকার ছাড়া বিনিয়োগ সম্ভব নয়।”
একটি বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলের উদ্যোক্তা পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “গত এক বছরে আমাদের অর্থনৈতিক অঞ্চলে একটি টাকাও বিনিয়োগ আসেনি। আস্থার সংকট যতদিন থাকবে, বিনিয়োগ হবে না। এখন ১০০ টাকা বিনিয়োগ করতে গেলে ২০০ টাকা চাঁদা দিতে হচ্ছে। তাহলে বিনিয়োগ কেন করবে উদ্যোক্তারা?”
ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি ব্যাংক খাতেও আতঙ্ক ছড়ানো হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে ১০টি ব্যাংকের দেউলিয়া হওয়ার গুজব ছড়ানো হয়। এতে বিদেশি ক্রেতা ও বিনিয়োগকারীরা শঙ্কিত হয়ে পড়েন। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, কিছু ব্যাংক সংকটে থাকলেও দেউলিয়া হওয়ার মতো পরিস্থিতি হয়নি।
অন্তর্বর্তী সরকার বিদেশি বিনিয়োগকারীদের টানতে কয়েকটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করলেও সাড়া মেলেনি। কারণ, স্থানীয় উদ্যোক্তারা যখন হয়রানির অভিযোগ করছেন, তখন বিদেশিরা স্বাভাবিকভাবেই দ্বিধায় পড়ছেন।
টি কে গ্রুপের ফাইন্যান্স অ্যান্ড অপারেশন ডিরেক্টর মোহাম্মদ শফিউল আতহার তসলিম বলেন, “বিনিয়োগের জন্য নিরাপত্তার নিশ্চয়তা সবচেয়ে জরুরি। আমি যদি ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করি, তার রিটার্ন আসবে কি না—এটাই মূল প্রশ্ন। সরকার চেষ্টা করছে, কিন্তু অনিশ্চয়তার কারণে অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়া যাচ্ছে না।”
অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তাফিজুর রহমান (সিপিডি) বলেন, “বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরির জন্য সবচেয়ে আগে দরকার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, নীতি-সংগত নিশ্চয়তা এবং ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক। জোর করে বা ভয়ভীতি দেখিয়ে অর্থনীতি সচল করা যায় না।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকার যদি সত্যিই ব্যবসাবান্ধব হতে চাইত, তাহলে নিয়মিত সংলাপ চালু করত। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়ী সমাজের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। এর ফলেই আস্থা ফেরেনি।”
অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, “অর্থনীতির প্রাণ হলো ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তা। তাঁদের টার্গেট করে হলো দেশের প্রবৃদ্ধিকে টার্গেট করা। সরকারের উচিত শিল্প ও বিনিয়োগকে টিকিয়ে রেখে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা।”
ব্যবসায়ীরা এখন একটি নির্বাচিত সরকারের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁদের মতে, বৈষম্য, হয়রানি ও বৈরী পরিবেশে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। সরকারের ভুল নীতি ও প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে আস্থা, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও রাজস্ব আয় সবক্ষেত্রেই ধস নেমেছে।
শিল্পোদ্যোক্তাদের ভাষায়—“ব্যবসায়ীদের যদি শত্রু মনে করা হয়, তাহলে অর্থনীতি কীভাবে বাঁচবে? ব্যবসা ধ্বংস হলে কর্মসংস্থান বন্ধ হবে, রাজস্ব হারাবে সরকার, আর ক্ষতিগ্রস্ত হবে সাধারণ মানুষই।”
বাংলাবার্তা/এমএইচ