
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের দ্বারে কড়া নাড়ছে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। কিন্তু ভোট ঘিরে যত দিন যাচ্ছে, ততই এক নতুন আতঙ্ক সামনে আসছে—ডিজিটাল অপপ্রচার। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) সহায়তায় তৈরি ভুয়া ভিডিও, বিকৃত ছবি ও মনগড়া তথ্য সামাজিক মাধ্যমে ছড়াচ্ছে ঝড়ের গতিতে। এর উদ্দেশ্য একটাই—রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হেয় করা, বিভ্রান্তি ছড়ানো এবং জনমতকে প্রভাবিত করা।
এই প্রবণতা নির্বাচনী পরিবেশের জন্য যে মারাত্মক হুমকি তৈরি করছে, তা এখন খোলাখুলি স্বীকার করছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। কিন্তু বাস্তবতা হলো—সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠানটি এখনো কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না। আচরণবিধিতে এআই-সংক্রান্ত ধারা যুক্ত করা হলেও মাঠপর্যায়ে তার প্রয়োগ সীমিত। বিশেষজ্ঞদের মতে, ইসির এ ধরনের অপব্যবহার ঠেকানোর সক্ষমতা প্রশ্নবিদ্ধ।
গবেষণা সংস্থা ডিসমিসল্যাব-এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে উদ্বেগজনক তথ্য। শুধু দুই মাসে (মে-জুন) দেশে ভুয়া তথ্য ছড়ানোর প্রবণতা বেড়েছে ১৭ শতাংশ। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেকই রাজনীতি-সংক্রান্ত। ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক, হোয়াটসঅ্যাপ ও এক্স—সব প্ল্যাটফর্মেই এআই-জেনারেটেড কনটেন্ট ছড়ানো হয়েছে।
এমনকি নারীনেত্রীদের চরিত্রহননের উদ্দেশ্যে তৈরি হয়েছে যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ ডিপফেক ভিডিও। একাধিক সংবাদপত্র ও টেলিভিশনের লোগো ব্যবহার করে বানানো হয়েছে অন্তত ১৭৬টি ভুয়া গ্রাফিক্স কার্ড। এর ৮৫ শতাংশ সরাসরি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছে।
সাইবার নিরাপত্তা প্রশিক্ষক আরিফ মঈনুদ্দিন বলেন, “ডিপফেক শনাক্তে আধুনিক প্রযুক্তি অপরিহার্য। কিন্তু কেবল প্রযুক্তি নয়, মানুষের প্রযুক্তি সাক্ষরতার অভাব সবচেয়ে বড় সমস্যা। আমাদের সমাজে এখনো বেশির ভাগ মানুষ তথ্য যাচাই করতে জানেন না। পছন্দের কিছু দেখলেই তারা তা বিশ্বাস করেন এবং ছড়িয়ে দেন। এর ফলে একটি ভুয়া তথ্যও কোটি মানুষের মনে প্রভাব ফেলে।”
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নির্বাচনের সময় এআই-ভিত্তিক অপপ্রচার ভয়াবহ আকার নিয়েছে।
-
যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে জো বাইডেনকে লক্ষ্য করে ডিপফেক ভিডিও ছড়ানো হয়েছিল।
-
ভারতের লোকসভা নির্বাচনে শতাধিক প্রার্থীর বিরুদ্ধে ভুয়া প্রচার চালানো হয়।
-
রোমানিয়ায় নির্বাচনে এআইর অপব্যবহার ধরা পড়লে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন বাতিল পর্যন্ত করতে হয়েছিল।
-
কানাডায় নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি-এর নামেও ছড়ানো হয় ভুয়া ছবি-ভিডিও।
এ অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), যুক্তরাষ্ট্র, চীন, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বহু দেশ এআই নিয়ন্ত্রণে আইন বা নীতি বাস্তবায়ন করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ এখনো কার্যকর আইন থেকে বঞ্চিত।
বাংলাদেশে এআই-সংক্রান্ত কোনো পূর্ণাঙ্গ আইন নেই। ফলে নির্বাচন কমিশন বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ভুয়া তথ্য ঠেকাতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছে না। জাতীয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কৌশল ও এআই নীতিমালার খসড়া থাকলেও তা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।
ইসির সংশোধিত আচরণবিধির খসড়ায় বলা হয়েছে, এআই ক্ষতিকর উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যাবে না। সামাজিক মাধ্যমে ভুয়া তথ্য, বিকৃত মুখ, মিথ্যা বক্তব্য প্রচার করলে প্রার্থিতা বাতিল পর্যন্ত হতে পারে। জরিমানার অঙ্কও বাড়ানো হয়েছে—৫০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত।
কিন্তু ইসির কর্মকর্তারাই স্বীকার করছেন, এখানে আইনি দুর্বলতা বড় সমস্যা। সামাজিক মাধ্যম নিয়ন্ত্রণেও ইসির সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, তারাই ভুয়া তথ্যের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী।
-
জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতা মুশফিক উস সালেহীন বলেন, “এআইর অপব্যবহারে জনগণ বিভ্রান্ত হচ্ছে, দলগুলোর সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নারীরা রাজনীতির প্রতি নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। এসব ঠেকাতে ইসির দৃশ্যমান পদক্ষেপ দরকার।”
-
বিএনপির প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু মনে করেন, এখনই প্রতিরোধ করা না গেলে জাতীয় নির্বাচনে মহামারি আকার নেবে এআইর অপব্যবহার।
-
জামায়াতে ইসলামীর হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, “প্রযুক্তি ও জনবল সরকারের হাতে। তাই ইসিকে তাদের সহযোগিতা নিয়ে এগোতে হবে।”
আইটি বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির বলেন, “ডিপফেক ভিডিও মুহূর্তেই লাখো মানুষের কাছে পৌঁছে যেতে পারে। নির্বাচনের মতো স্পর্শকাতর সময়ে এটি ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে পারে। কেবল আইন করলেই হবে না, এর প্রয়োগও নিশ্চিত করতে হবে।”
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য জেসমিন টুলি বলেন, ইসির নিজস্ব কোনো সাইবার সিকিউরিটি সেল বা ইউনিট নেই। নির্বাচনের আগে এমন একটি বিশেষায়িত ইউনিট গঠন না করলে ঝুঁকি সামাল দেওয়া কঠিন হবে।
ফ্যাক্ট চেকার কদরুদ্দিন শিশির বলেন, “ভুয়া তথ্য চিহ্নিত করার সক্ষমতা ইসির নেই। ফ্যাক্ট চেক প্ল্যাটফর্ম ও গণমাধ্যমের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করতে হবে। কারণ, একটি অপতথ্য কয়েক ঘণ্টার মধ্যে নির্বাচনে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।”
নির্বাচন কমিশন স্বীকার করছে, নির্বাচনের আগে এআইর অপব্যবহার বড় হুমকি। কিন্তু কার্যকর উদ্যোগের অভাব, আইনগত সীমাবদ্ধতা এবং সাইবার সিকিউরিটি কাঠামোর দুর্বলতা বাংলাদেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বিপর্যয়ের মুখে ফেলতে পারে।
বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক নেতাদের একথাই এখন এক সুরে উচ্চারিত হচ্ছে—ভুয়া ভিডিও ও তথ্যের লাগাম টানতে না পারলে আসন্ন নির্বাচন কেবল অগ্রহণযোগ্যই নয়, বরং দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎকেও অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ