
ছবি: সংগৃহীত
ব্রিটেনের লেবার পার্টির এমপি এবং বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগ্নি টিউলিপ সিদ্দিক আবারও আলোচনার কেন্দ্রে। সম্প্রতি তাঁর বাংলাদেশি নাগরিকত্ব সংক্রান্ত বিষয়ে নতুন তথ্য ফাঁস হওয়ায় ব্রিটিশ রাজনীতিতে অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। বিষয়টি শুধু টিউলিপের ব্যক্তিগত ভাবমূর্তির জন্য নয়, বরং লেবার পার্টির জন্যও বড় ধরনের রাজনৈতিক সংকট ডেকে আনতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
ব্রিটিশ দৈনিক দ্য টাইমস এবং বাংলাদেশি দৈনিক প্রথম আলো যৌথ অনুসন্ধানে দাবি করেছে, টিউলিপ সিদ্দিক তাঁর নাগরিকত্বের বিষয়ে অসত্য তথ্য দিয়েছেন। তিনি আগে বারবার বলেছেন যে তাঁর কোনো বাংলাদেশি জাতীয় পরিচয়পত্র বা পাসপোর্ট নেই। কিন্তু অনুসন্ধানে উঠে এসেছে ভিন্ন তথ্য।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০১ সালে টিউলিপের নামে ঢাকায় একটি পাসপোর্ট ইস্যু করা হয়েছিল। সে সময় তাঁর বয়স মাত্র ১৯ বছর। পরবর্তীতে ২০১১ সালে তাঁর নামে একটি জাতীয় পরিচয়পত্রও ইস্যু হয়। শুধু তাই নয়, ঢাকার আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিস থেকে তিনি নিজে উপস্থিত হয়ে পাসপোর্ট নবায়নের আবেদনও করেছিলেন বলে সরকারি রেকর্ডে উল্লেখ আছে। নির্বাচন কমিশনের ডাটাবেইসেও তাঁর ভোটার নিবন্ধন নম্বর এবং পাসপোর্ট নম্বরের সঠিক তথ্য পাওয়া গেছে। সব মিলিয়ে বিষয়টি তাঁর পূর্ববর্তী বক্তব্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
এমন প্রমাণ সামনে আসায় বলা হচ্ছে, টিউলিপ শুধু নিজের নাগরিকত্ব সম্পর্কেই মিথ্যা তথ্য দেননি, বরং তিনি বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে বিভিন্ন সুবিধাও নিয়েছেন। বিশেষ করে জমি বরাদ্দ সংক্রান্ত অভিযোগ এখন আবার সামনে এসেছে। অভিযোগ রয়েছে, ঢাকায় বেআইনিভাবে একটি প্লট তিনি পেয়েছিলেন। এমনকি নিজের মায়ের, ভাইয়ের ও বোনের জন্যও তিনি প্লট সুবিধা নিশ্চিত করেছিলেন। সমালোচকরা বলছেন, খালার রাজনৈতিক ক্ষমতার সুযোগ নিয়েই তিনি এসব সুবিধা আদায় করেছিলেন।
তবে এসব অভিযোগ একেবারেই অস্বীকার করেছে টিউলিপ সিদ্দিকের কার্যালয়। তাঁর মুখপাত্রের দাবি, “বাংলাদেশের যে নথিপত্র দেখানো হচ্ছে, তা ভুয়া এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এগুলো বানানো হয়েছে টিউলিপের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্য।” তিনি আরো বলেন, টিউলিপ সবসময় স্বচ্ছ ছিলেন এবং ব্রিটিশ নাগরিক হিসেবেই রাজনৈতিক জীবন গড়ে তুলেছেন। তাই এসব অভিযোগ কেবলমাত্র ‘কুৎসা প্রচার’ ছাড়া কিছু নয়।
টিউলিপ সিদ্দিক দীর্ঘদিন ধরে লেবার পার্টির হয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে সক্রিয় ভূমিকা রেখে আসছেন। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত হিসেবে তিনি ব্রিটেনে প্রবাসী বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়ও। কিন্তু নাগরিকত্ব ইস্যুতে মিথ্যা তথ্য দেওয়ার অভিযোগ তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। অনেকেই মনে করছেন, এই বিতর্ক লেবার পার্টির ভেতরে টিউলিপকে অস্বস্তিকর অবস্থায় ফেলবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ব্রিটিশ রাজনীতিতে সততা ও স্বচ্ছতার প্রশ্ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কোনো এমপির নাগরিকত্ব সংক্রান্ত জটিলতা শুধু তাঁর ব্যক্তিগত ক্যারিয়ার নয়, দলের ভাবমূর্তিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। টিউলিপের ক্ষেত্রেও একই ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। বিশেষ করে ব্রেক্সিট-পরবর্তী সময়ে অভিবাসন ও নাগরিকত্ব ইস্যু নিয়ে ব্রিটেনে যে সংবেদনশীলতা রয়েছে, তাতে এই বিতর্ক বড় আকার ধারণ করতে পারে।
বাংলাদেশে নাগরিকত্ব ও জাতীয় পরিচয়পত্র সাধারণত কেবল নাগরিকদের জন্য ইস্যু করা হয়। ফলে টিউলিপ যদি সত্যিই এসব সুবিধা নিয়ে থাকেন, তবে তাঁর বাংলাদেশি নাগরিকত্ব প্রমাণিত হয়। এ কারণে বিষয়টি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেও আলোচনায় এসেছে। অনেকে মনে করছেন, শেখ হাসিনার পরিবারের সদস্য হওয়ায় তিনি বিশেষ সুবিধা পেয়েছিলেন। আবার কেউ কেউ বলছেন, এই অভিযোগগুলো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ষড়যন্ত্র।
টিউলিপ সিদ্দিকের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার দীর্ঘদিন ধরে স্থিতিশীল থাকলেও সাম্প্রতিক এই নাগরিকত্ব বিতর্ক নতুন এক ঝুঁকি তৈরি করেছে। লেবার পার্টি যদি বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত শুরু করে, তাহলে তাঁর এমপি পদও ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। একই সঙ্গে প্রবাসী বাংলাদেশি কমিউনিটির মধ্যেও তাঁর অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়তে পারে।
সব মিলিয়ে, নাগরিকত্ব নিয়ে এই বিতর্ক কেবল টিউলিপের ব্যক্তিগত রাজনৈতিক জীবনের জন্যই নয়, বরং শেখ হাসিনার পরিবারের ভাবমূর্তির ওপরও প্রভাব ফেলতে পারে। এখন দেখার বিষয়, লেবার পার্টি এবং ব্রিটিশ রাজনীতি এই সংকটকে কতটা গুরুত্ব দিয়ে নেয় এবং টিউলিপ কীভাবে এর মোকাবিলা করেন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ