
ছবি: সংগৃহীত
অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি ছাড়া টেকসই রাজস্ব আয় সম্ভব নয়—এমন মন্তব্য করে কর আদায় ব্যবস্থায় সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার অর্থ উপদেষ্টা ও সাবেক বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেছেন, ব্যবসা-বাণিজ্য সমৃদ্ধ হলে এবং বেসরকারি খাত শক্তিশালী হলে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে কর প্রদান করবে। তাই রাজস্ব কর্মকর্তাদের উদ্দেশে তিনি সতর্ক বার্তা দিয়ে বলেন—‘করদাতাদের কাছ থেকে জোর বা ধমক দিয়ে কর আদায় করা যাবে না।’
বৃহস্পতিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) রাতে রাজধানীর একটি হোটেলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) উদ্যোগে আয়োজিত বাংলাদেশ সিঙ্গেল উইন্ডো (বিএসডব্লিউ) প্রকল্পের মাইলফলক উদযাপন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, “ব্যবসা ছাড়া, বেসরকারি খাতের উন্নয়ন ছাড়া আমরা এক পা-ও এগোতে পারব না। প্রায়ই সমালোচনা হয়, আমাদের ট্যাক্স-টু-জিডিপি অনুপাত খুবই কম। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ব্যবসা যদি সমৃদ্ধ না হয়, বাণিজ্য যদি বাড়ে না, তাহলে কর সংগ্রহ কোথা থেকে হবে? কর আদায়ের মূল উৎস হলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি।”
তিনি আরও বলেন, রাজস্ব আহরণকে কেবল কর সংগ্রহের প্রক্রিয়া হিসেবে দেখলে ভুল হবে। সেবা প্রদান, আস্থা তৈরি এবং ব্যবসায়ীদের জন্য সুবিধাজনক পরিবেশ নিশ্চিত করাই রাজস্ব প্রশাসনের প্রধান দায়িত্ব।
ড. সালেহ উদ্দিন দৃঢ়ভাবে উল্লেখ করেন, “ডিজিটালাইজেশনের ক্ষেত্রে কোনো আপস করা যাবে না। সেবা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাংলাদেশ সিঙ্গেল উইন্ডো কেবল রাজস্ব সংগ্রহের মাধ্যম নয়, বরং ব্যবসায়ীদের জন্য একটি নতুন পথ তৈরির প্রক্রিয়া। এর মাধ্যমে বিভিন্ন সংস্থা যুক্ত হবে, সেবার মান বাড়বে এবং করদাতাদের আস্থা তৈরি হবে।”
তিনি জানান, এনবিআরের এই উদ্যোগ আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বাণিজ্য প্রক্রিয়া সহজ করার জন্য বড় ভূমিকা রাখছে। বিশ্বায়নের যুগে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে এই ধরনের ডিজিটাল সেবা আরও সম্প্রসারণ করতে হবে।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, বাংলাদেশ সিঙ্গেল উইন্ডো (বিএসডব্লিউ) প্ল্যাটফর্ম চালুর পর থেকেই ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন গতি এসেছে। আমদানি-রপ্তানির জন্য প্রয়োজনীয় সার্টিফিকেট, লাইসেন্স ও পারমিট (সিএলপি) এখন অনলাইনে ইস্যু করা হচ্ছে।
-
২০২৫ সালের ২ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত মোট ৫ লাখ ৭৮ হাজার ৪৯১টি সিএলপি অনলাইনে ইস্যু হয়েছে।
-
এর মধ্যে ৮৪ শতাংশ আবেদন এক ঘণ্টার মধ্যেই নিষ্পত্তি হয়েছে।
-
আর ৯৫ শতাংশ আবেদন একদিনের মধ্যেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পন্ন হয়েছে।
এটি যে ব্যবসায়ী ও আমদানিকারক-রপ্তানিকারকদের জন্য এক বিশাল সুবিধা তৈরি করেছে, তা অনুষ্ঠানে বিভিন্ন ভিডিও ক্লিপের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়।
এনবিআরের ডিজিটাল উদ্যোগের অংশ হিসেবে করদাতাদের অনলাইন রিটার্ন জমা দেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। এ জন্য করবর্ষ ২০২৪-২৫ এ যারা সর্বাধিক কর্মীর আয়কর বিবরণী অনলাইনে দাখিল করেছে, তাদেরকে ই-রিটার্ন চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করা হয়।
সম্মাননা প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো হলো—
-
সোনালী ব্যাংক পিএলসি
-
ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেড
-
ব্র্যাক
-
ব্যুরো বাংলাদেশ
-
রেনেটা পিএলসি
তাদের প্রতিনিধিদের হাতে এনবিআর স্মারক তুলে দেয়।
গত করবর্ষে সরকার বেশ কিছু ক্ষেত্রে অনলাইন রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করেছে। এর আওতায় এসেছেন—
-
ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সরকারি কর্মচারী
-
সব তফসিলি ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারী
-
ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো ও ইউনিলিভার বাংলাদেশ
-
সব মোবাইল অপারেটরের কর্মকর্তা-কর্মচারী
এসব প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণের কারণে অনলাইনে রিটার্ন দাখিলে ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে বলে অনুষ্ঠানে জানানো হয়।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিন, আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আনিসুজ্জামান চৌধুরী। সভাপতিত্ব করেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান।
অর্থ উপদেষ্টার বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে, বাংলাদেশে কর সংস্কৃতিকে টেকসই করতে হলে ‘ভয় বা জোরের পরিবর্তে আস্থা, প্রবৃদ্ধি ও সেবার সংস্কৃতি’ তৈরি করতে হবে। এনবিআরের ডিজিটাল উদ্যোগ, বিশেষত বাংলাদেশ সিঙ্গেল উইন্ডো প্রকল্প এবং ই-রিটার্ন বাধ্যতামূলক করার পদক্ষেপ কর প্রশাসনকে একটি নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছে। তবে এই যাত্রায় ব্যবসায়ীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণই হবে প্রকৃত সাফল্যের চাবিকাঠি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ