
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশে চলতি বর্ষা মৌসুমে ২০ থেকে ৩০টি জেলা জুড়ে বড় ধরনের বন্যা দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন কানাডার সাসকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ুবিষয়ক গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ। তার মতে, আগস্টের মাঝামাঝি থেকে সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে এই বন্যা দেশের সাম্প্রতিক বছরের অন্যতম ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে পরিণত হতে পারে। তিনি সতর্ক করে দিয়েছেন, যদি এই পূর্বাভাস সত্যি হয়, তবে ২০২৫ সালের এই বন্যা বিগত ৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় ও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।
রবিবার (১০ আগস্ট) দুপুরে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডি থেকে প্রকাশিত এক পোস্টে মোস্তফা কামাল পলাশ এই আশঙ্কার কথা জানান। পোস্টটিতে তিনি শুধু সতর্কতাই দেননি, বরং সম্ভাব্য কারণ, বন্যার ধরন, সময়কাল এবং ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার সম্ভাব্য বিস্তৃতি সম্পর্কেও বিশদ ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
মোস্তফা কামাল পলাশ তার পোস্টে বলেন, বর্ষাকালের স্বাভাবিক বা "প্রকৃত" বন্যা বলতে বোঝায়—ভারতের গঙ্গা নদী অববাহিকা হয়ে পানি প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশের পদ্মা নদীতে প্রবেশ করা এবং তা থেকে উপকূলবর্তী জেলাগুলো প্লাবিত হওয়া। একইভাবে, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদীর উজান থেকে নেমে আসা অতিরিক্ত পানি বাংলাদেশের উত্তর, উত্তর-পশ্চিম ও মধ্যাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা ডুবিয়ে দেওয়া।
তার মতে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশব্যাপী বর্ষাকালের এমন বৃহৎ বন্যা দেখা যায়নি। ২০২০ সালের পরে এ ধরনের বন্যা আর হয়নি। যদিও ২০২২ সালে সিলেট ও আশপাশের এলাকায় এবং ২০২৪ সালে চট্টগ্রাম বিভাগে যে বন্যা হয়েছিল, তা মূলত পাহাড়ি ঢল বা "ফ্ল্যাশ ফ্লাড" ছিল। কিন্তু আসন্ন বন্যাটি হবে ভিন্ন প্রকৃতির—এটি হবে বর্ষাকালের মৌসুমি নদীবন্যা, যা দীর্ঘস্থায়ী এবং অধিকতর বিস্তৃত প্রভাব ফেলতে পারে।
গবেষক জানান, ২০২৫ সালের এই সম্ভাব্য বন্যাটি আগস্টের ১৫ তারিখের পর থেকে শুরু হয়ে সেপ্টেম্বরের ১০ তারিখ পর্যন্ত চলতে পারে। এই সময়ে পদ্মা, যমুনা, তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরবর্তী বিস্তীর্ণ অঞ্চল তলিয়ে যেতে পারে। বন্যার কারণে ২০ থেকে ৩০টি জেলা আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে প্লাবিত হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে দেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলা যেমন—লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, রংপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ; মধ্যাঞ্চলের টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, রাজবাড়ী; দক্ষিণাঞ্চলের ফরিদপুর, গোপালগঞ্জসহ একাধিক জেলা। পাশাপাশি উপকূলীয় কিছু অঞ্চলও নদীর পানি বৃদ্ধির প্রভাবে ডুবে যেতে পারে।
মোস্তফা কামাল পলাশ তার পোস্টে লিখেছেন, “আমি মনেপ্রাণে চাইব আমার পূর্বাভাস ভুল প্রমাণিত হোক। বাংলাদেশের মানুষ যেন কোনো বড় ধরনের বন্যার সম্মুখীন না হয়। কিন্তু বৈজ্ঞানিক তথ্য ও গত কয়েক মাসের আবহাওয়াগত বিশ্লেষণ বলছে, বড় ধরনের বন্যার সম্ভাবনা এবার উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।”
তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশের চার প্রধান নদী—পদ্মা, যমুনা, তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র—যদি উজানের পানি বৃদ্ধির কারণে একসঙ্গে উচ্চস্রোত ধারণ করে, তবে দেশের নদীবেষ্টিত ও নিম্নাঞ্চলগুলোতে দ্রুত পানি ঢুকে পড়তে পারে। ফলে ফসলি জমি, বসতবাড়ি, রাস্তাঘাট, এমনকি কিছু শিল্পাঞ্চলও হুমকির মুখে পড়তে পারে।
পোস্টের শেষাংশে তিনি জানিয়েছেন, এই পূর্বাভাসের পেছনে যে তথ্য ও প্রমাণ রয়েছে, তা ইতোমধ্যেই তিনি ‘আবহাওয়া ডট কম’ ওয়েবসাইটে একটি গবেষণামূলক প্রবন্ধে প্রকাশ করেছেন। সেখানে বৈশ্বিক আবহাওয়ার ধরন, বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস, নদীর পানি প্রবাহের স্যাটেলাইট তথ্য এবং গত বছরের তুলনামূলক বিশ্লেষণ দেওয়া হয়েছে।
এই সতর্কবার্তা বিশেষজ্ঞ মহলে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, বড় ধরনের বন্যা ঠেকানো না গেলেও আগাম সতর্কতা ও প্রস্তুতির মাধ্যমে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব। এর জন্য নদীর পানি প্রবাহ নিয়মিত পর্যবেক্ষণ, উজানের দেশগুলোর সঙ্গে তথ্য বিনিময়, আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা, ত্রাণের মজুদ গড়ে তোলা এবং ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মানুষকে আগেভাগে সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা জরুরি।
বাংলাদেশে প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে বন্যা স্বাভাবিক ঘটনা হলেও, বড় ধরনের মৌসুমি বন্যা কেবল মানবিক বিপর্যয়ই নয়, অর্থনীতিতেও ব্যাপক প্রভাব ফেলে। কৃষি, অবকাঠামো, পরিবহন, স্বাস্থ্য এবং শিক্ষাখাতসহ প্রায় সবক্ষেত্রেই এর ক্ষতি দীর্ঘস্থায়ী হয়।
গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশের এই সতর্কবার্তা তাই শুধু আবহাওয়াবিষয়ক তথ্য নয়, বরং একটি মানবিক আহ্বান—যাতে সরকার, স্থানীয় প্রশাসন ও সাধারণ মানুষ আগেভাগেই প্রস্তুত হতে পারে এবং সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি যতটা সম্ভব কমিয়ে আনা যায়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ