
ছবি: সংগৃহীত
২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে দেশের রাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের পর যে বিষয়টি হঠাৎই সামনে চলে আসে, তা হলো বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের ভেতরকার অপ্রকাশিত দুর্নীতি ও নাজুক অর্থনৈতিক বাস্তবতা। বছরের পর বছর ধরে “সুস্থ” ও “স্থিতিশীল” আখ্যা দিয়ে যেসব ব্যাংকের আর্থিক পরিস্থিতি তুলে ধরা হচ্ছিল, রাজনৈতিক পালাবদলের পর সেইসব প্রতিষ্ঠানের ব্যালান্সশিট যে “সাজানো” ও “অবাস্তব” ছিল, তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
এই ব্যর্থতার দায় এখন এসে পড়েছে ব্যাংকের অডিটর, রেটিং এজেন্সি, স্বতন্ত্র পরিচালক ও এমনকি নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর ওপর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি কোনো একক প্রতিষ্ঠানের নয়, বরং এক বিশাল “সম্মিলিত ব্যর্থতা”—যেখানে তথ্য লুকোনো, সত্য আড়াল, এবং দায় এড়ানো ছিল প্রাতিষ্ঠানিক আচরণ।
গভর্নরের চরম উদ্বেগ: “ব্যালান্সশিটগুলো কাল্পনিক”
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর এক আলোচনায় বলেন, “বেশিরভাগ ব্যাংকের ব্যালান্সশিট বাস্তব নয়, বরং সাজানো তথ্যের ওপর দাঁড়ানো।” তিনি আরো বলেন, “আমি যদি অডিট ফার্মগুলোকে তাদের রিপোর্টের ভিত্তিতে বিচার করি, তাহলে একটি যোগ্য অডিট প্রতিষ্ঠানও পাওয়া যাবে না।”
গভর্নরের এ বক্তব্য শুধু উদ্বেগ নয়, বরং দেশের আর্থিক কাঠামোর ভঙ্গুরতা ও অসততার উপর এক গাঢ় আলোকপাত।
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক—‘সত্য’ থেকে শত কোটি দূরে
২০২৩ সালের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংককে “সত্য ও ন্যায্য” হিসাবে চিত্রায়িত করেছিল শফিক বসাক অ্যান্ড কো এবং রহমান মোস্তফা আলম অ্যান্ড কো। অথচ মাত্র এক বছরের ব্যবধানে, ২০২৪ সালের প্রতিবেদনে জানা যায়, ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪৯ হাজার কোটি টাকায়। এক বছরের ব্যবধানে কী এমন হলো?
এই “অন্ধতা” কীভাবে সম্ভব—সেটি নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠছে পেশাদারিত্ব, নিরীক্ষার নৈতিকতা ও রিপোর্টের স্বচ্ছতা নিয়ে।
রেটিং এজেন্সি: দায়িত্ব না নেয়ার “দামি প্যাকেজ”
নিরীক্ষা রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে ব্যাংক রেটিং করে থাকে ক্রেডিট রেটিং এজেন্সিগুলো। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক এমন সময়েও পেয়েছে দীর্ঘমেয়াদে ‘A+’ ও স্বল্পমেয়াদে ‘ST-2’ রেটিং, যখন তারা আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতেও হিমশিম খাচ্ছিল।
এই রেটিং দিয়েছে Emerging Credit Rating Limited (ECRL)।
শুধু ফার্স্ট সিকিউরিটি নয়, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, ন্যাশনাল ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক এবং সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক—সবার ক্ষেত্রেই দেখা গেছে একই রকম রেটিং এর ভেলকি, যেখানে ভেতরের নাজুকতা একেবারে আড়ালে ছিল।
ইসলামী ব্যাংক এমনকি ‘AAA’ রেটিং পায়, যখন সংবাদমাধ্যমে উঠে আসে ভুয়া প্রতিষ্ঠানকে শত শত কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার স্ক্যান্ডাল।
“স্বাধীন” পরিচালকরা কতটা স্বাধীন ছিলেন?
ব্যাংকের বোর্ডে থাকা স্বতন্ত্র পরিচালকদের কাজই হলো সাধারণ আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা করা, অনিয়ম হলে রিপোর্ট করা। কিন্তু তারা কতটা এই দায়িত্ব পালন করেছেন?
জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও স্বতন্ত্র পরিচালক ড. জামালউদ্দিন আহমেদ বলেন, “আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আপত্তি জানিয়েছিলাম। তারা ব্যবস্থা নেয়নি।” কী বিষয়ে আপত্তি ছিল, জানতে চাইলে বলেন, “এই মুহূর্তে মনে নেই।” এমন অস্পষ্টতা ও দায় এড়ানোই প্রশ্ন তোলে—তারা কি আদৌ স্বাধীন ছিলেন, নাকি বোর্ডের ইচ্ছামতো চলা 'বেতনভোগী' প্রতিনিধি?
বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন?
ড. তৌফিক আহমদ চৌধুরী, (সাবেক মহাপরিচালক, বিআইবিএম): “এই পরিস্থিতি প্রমাণ করে অডিট ফার্ম, রেটিং এজেন্সি ও পরিচালকরা অনেক ক্ষেত্রেই দায়িত্বহীন থেকেছে। সরকারকে এখনই কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে—দোষীদের জবাবদিহির আওতায় আনতে না পারলে এই সংকট আবার ফিরে আসবে।”
তিনি আরো বলেন, “মানসম্মত অডিটের জন্য ফি বাড়ানো দরকার, যেন নিরীক্ষকের পেশাদার স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়।”
এন কে এ মবিন, (প্রেসিডেন্ট, আইসিএবি): “অডিট ফার্মগুলো আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করলেও তারা ব্যাপক যাচাই না করে নমুনা-ভিত্তিক মূল্যায়নে নির্ভর করে। এতে অনেক সময় বাস্তব আর্থিক দুর্দশা আড়াল থেকে যায়।”
নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর ভূমিকা কোথায়?
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (BSEC) এর মুখপাত্র আবুল কালাম বলেন, “কমিশনে লোকবল স্বল্পতা রয়েছে। তাই সব কোম্পানির খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ সম্ভব হচ্ছে না।” তবে কিছু অডিট ফার্মের বিষয়ে ইতিমধ্যে ফিনান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলে (FRC) পাঠানো হয়েছে।
FRC চেয়ারম্যান মো. সাজ্জাদ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, “আমরা ব্যাংকগুলোর নিরীক্ষকদের ভূমিকা খতিয়ে দেখছি। এক মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ হবে এবং পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”
একটি বড় শিক্ষা: শুধু রেটিং দিয়ে সত্য আড়াল করলে বিপর্যয় অনিবার্য
১৯৭০-এর দশকে বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতে যে দুর্বলতার সূচনা হয়েছিল, তা থেকে এখনো বের হয়ে আসতে পারেনি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। খেলাপি ঋণ, রাজনৈতিক নিয়োগ, দুর্নীতিপূর্ণ ঋণ অনুমোদন এবং দায়মুক্ত অডিট—সব মিলিয়ে একটি দুর্বিন্যস্ত চিত্র উঠে এসেছে, যা শুধুই অর্থনৈতিক সংকট নয়, বরং বিশ্বাসের সংকট।
করণীয় কী?
জবাবদিহি নিশ্চিত করা: নিরীক্ষক, রেটিং এজেন্সি ও পরিচালকদের পেশাগত অবহেলার জন্য শাস্তির ব্যবস্থা।
স্বাধীনতা ও স্বচ্ছতা: অডিট ফার্ম ও রেটিং সংস্থাগুলোর আর্থিক নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে কমিশনের সরাসরি তদারকি।
প্রতিষ্ঠানগত সংস্কার: স্বতন্ত্র পরিচালক ও পরিচালনা পর্ষদের গঠন ঢেলে সাজানো।
রেগুলেটরি শক্তি বাড়ানো: BSEC ও FRC-র জনবল ও সক্ষমতা বাড়িয়ে নিয়মিত আর্থিক মূল্যায়ন চালু করা।
একটি দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা শুধু অর্থনীতির চালিকাশক্তি নয়, বরং সমাজের আস্থা ও ভবিষ্যতের প্রতীক। আজ বাংলাদেশ যেই সংকটে পড়েছে, তা মূলত তথ্য গোপন, দায়িত্বহীনতা আর নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্বলতার মিশেলে সৃষ্ট এক দীর্ঘমেয়াদি ব্যর্থতা।
এই ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে যদি এখনই ব্যবস্থা না নেওয়া হয়—তবে আগামী দিনের আর্থিক ব্যবস্থাপনা শুধু দুর্বল হবে না, হতে পারে আরও ভয়াবহ বিপর্যয়ের পূর্বাভাস।
বাংলাবার্তা/এমএইচ