
ছবি: সংগৃহীত
আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে দেশের রাজনীতিতে নানামুখী তৎপরতা শুরু হয়েছে। ভোটের মাঠে বড় বড় দলগুলো প্রকাশ্যে প্রচারণা চালালেও ভেতরে ভেতরে চলছে আসন সমঝোতা, নতুন জোট গঠন এবং পুরনো সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত করার প্রচেষ্টা। রাজনৈতিক দলগুলোর কেন্দ্রীয় নেতারা যেমন ভোটারদের কাছে ধরনা দিচ্ছেন, তেমনি ব্যাকডোরে একে অপরের সঙ্গে বৈঠক আর দর-কষাকষিতে ব্যস্ত। নির্বাচনী কৌশল নির্ধারণে প্রতিদিনই হচ্ছে অগণিত বৈঠক, মিটিং, গোপন সমঝোতা ও বার্তালাপ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এখন পর্যন্ত নির্বাচনকে সামনে রেখে অন্তত তিনটি বড় জোট গঠনের আভাস মিলেছে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটে ইতিমধ্যে যুগপৎ আন্দোলনের শরিক ১২ দল, সমমনা জোট, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামসহ একাধিক দলের অংশগ্রহণ প্রায় নিশ্চিত। এর পাশাপাশি বিএনপি গণতন্ত্র মঞ্চ, এবি পার্টি, এনসিপি ও গণ-অধিকার পরিষদকেও অন্তর্ভুক্ত করতে নিয়মিত আলোচনায় বসছে। তবে বিএনপি স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, তারা জামায়াতের সঙ্গে কোনো অবস্থাতেই জোটে যাবে না।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী ইতিমধ্যে নিজেদের মতো করে একটি নতুন ইসলামী রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ (চরমোনাই পীরের দল), খেলাফত মজলিস এবং হেফাজতে ইসলামের একাংশকে সঙ্গে নিয়ে আলাদা একটি ইসলামী জোট গঠনের আলোচনায় রয়েছে জামায়াত। যদিও মামুনুল হকের নেতৃত্বাধীন হেফাজতের অংশ এই প্রক্রিয়ায় শেষ পর্যন্ত না-ও থাকতে পারে বলে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।
আসন সমঝোতার ক্ষেত্রে এখনো বড় ধরনের অচলাবস্থা বিরাজ করছে। বিএনপি জোটসঙ্গীদের জন্য সর্বোচ্চ ৬০টি আসন ছেড়ে দিতে রাজি, তবে এনসিপি ৩০টি আসন ধরে দরকষাকষি করছে। বিএনপির ভেতরের সূত্র জানাচ্ছে, বাস্তবে ১৭টির বেশি আসন ছাড়তে তারা প্রস্তুত নয়। অন্যদিকে জামায়াত সরাসরি বিএনপির সঙ্গে না থাকলেও অন্তত ৫০টি আসনে ছাড় চাইছে। কিন্তু সে বিষয়ে নিশ্চয়তা না পাওয়ায় তারা নির্বাচনে না যাওয়ার হুমকি দিচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ধরনের হুমকি আসলে দর-কষাকষির কৌশল, শেষ পর্যন্ত সবাই নির্বাচনে যাবে।
একই সময়ে আওয়ামী লীগও নিজেদের রাজনৈতিক সমীকরণ সাজাচ্ছে জাতীয় পার্টিকে ঘিরে। আদালতের এক রায়ের পর জি এম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি নতুনভাবে আলোচনায় এসেছে। ক্ষমতাসীন দলের ভেতরে অনেকে মনে করছেন, জাতীয় পার্টিকে সক্রিয় করে তুললে নির্বাচনী মাঠে বহুদলীয় প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা সহজ হবে। এমনকি আওয়ামী লীগের নিষ্ক্রিয় বা হতাশ সমর্থকরাও জাতীয় পার্টির দিকে ঝুঁকতে পারে। ফলে রংপুর, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ ও খুলনা অঞ্চলের বেশ কিছু আসনে জাতীয় পার্টিকে সিরিয়াস প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবেই বিবেচনা করছে বিএনপি ও জামায়াত নেতৃত্বাধীন জোট।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী মনে করেন, যারা এখন নির্বাচনে না যাওয়ার কথা বলছে তারাও শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ নেবে। তার ভাষায়, “গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্য নির্বাচন ছাড়া বিকল্প নেই। ভোটই গণতন্ত্রের প্রথম সোপান।”
রাজনীতির এই টানাপোড়েনের ভেতর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান স্পষ্ট করেছেন, আন্দোলনে শরিক সব দলকেই আলোচনার মাধ্যমে সঙ্গে নেওয়ার চেষ্টা চলছে। অন্যদিকে জামায়াতের নেতা এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেছেন, দেশের স্বার্থে তারা আলোচনায় বসতে প্রস্তুত হলেও বিএনপি তাদের সঙ্গে ঐক্য করবে না বলে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে।
সব মিলিয়ে নির্বাচন ঘিরে জোট রাজনীতির মাঠে এখন এক অদৃশ্য দৌড়ঝাঁপ চলছে। প্রকাশ্যে দলগুলো একেক ধরনের অবস্থান নিলেও অন্তরালে চলছে হিসাব-নিকাশ, দরকষাকষি আর আসন ভাগাভাগির কৌশল। কারা শেষ পর্যন্ত কাকে নিয়ে মাঠে নামবে—এই প্রশ্নের উত্তর মিলবে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরই।
বাংলাবার্তা/এমএইচ