
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত পরিস্থিতি দিন দিন জটিল ও স্পর্শকাতর হয়ে উঠছে। মিয়ানমারে চলমান গৃহযুদ্ধ, আরাকান আর্মি ও আরসার মতো সশস্ত্র গোষ্ঠীর তৎপরতা, সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোর উত্তেজনা, এবং রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশসহ নানা ইস্যুতে বাংলাদেশ সরকারকে নানা ধরনের নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এর মধ্যেই সম্প্রতি সীমান্ত করিডর নিয়ে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা তুঙ্গে উঠেছে। তবে সেনাবাহিনী স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, এই করিডর ইস্যুতে তারা কোনো ধরনের ভূমিকা পালন করবে না, বরং সীমান্তের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই তাদের প্রধান দায়িত্ব।
সোমবার (২৬ মে) ঢাকার সেনা সদরে অনুষ্ঠিত এক ব্রিফিংয়ে সেনাবাহিনীর অপারেশন শাখার পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজিম উদ দৌলা বলেন, সীমান্তের নিরাপত্তা নিয়ে কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া হবে না। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে করিডর স্থাপন একটি অতিমাত্রায় স্পর্শকাতর ও কৌশলগত বিষয়। সেনাবাহিনী এর সঙ্গে কোনোভাবেই সম্পৃক্ত হবে না এবং এমন কোনো কর্মকাণ্ডে নিজেদের জড়াবে না যা দেশের নিরাপত্তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে।
তিনি আরও বলেন, “আমরা সর্বশক্তি দিয়ে সীমান্তে অবস্থান নিয়েছি। যতক্ষণ আমাদের সামর্থ্য থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত সীমান্ত রক্ষায় আমরা দায়িত্ব পালন করবো। এখানে কোনো ধরনের গাফিলতির সুযোগ নেই।”
তিনি আরও উল্লেখ করেন, “বর্তমানে মিয়ানমারের আরসা (আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি) সশস্ত্র অবস্থায় সীমান্তে টহল দিচ্ছে। এটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। সীমান্ত পরিস্থিতি এখন বেশ সংবেদনশীল, তাই আমরা সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করছি।”
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ব্রিগেডিয়ার নাজিম জানান, আরাকান আর্মির সঙ্গে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কোনো ধরনের সরাসরি যোগাযোগ নেই। সেনাবাহিনী তাদের কার্যক্রম নিরপেক্ষভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে ব্যবস্থা নিচ্ছে।
ব্রিফিংয়ে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে আসে, যা পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরাপত্তা পরিস্থিতি সম্পর্কিত। সেখানে সক্রিয় একটি নিষিদ্ধ সশস্ত্র গোষ্ঠী ‘কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট’ (Kuki Chin National Front বা KNF), যা স্থানীয়ভাবে ‘বম পার্টি’ নামে পরিচিত। এই সংগঠনের সদস্যদের জন্য ৩০ হাজার ইউনিফর্ম সংগ্রহ করা হয়েছে—এমন একটি তথ্য সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর সেনাবাহিনী বিষয়টি গুরুত্বসহকারে আমলে নিয়েছে।
ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, “বিষয়টি সত্য কি না, তা খুঁজে দেখা হচ্ছে। কারণ বম সম্প্রদায়ের মোট জনসংখ্যা প্রায় ১২,০০০। তাহলে ৩০ হাজার পোশাক কারা ব্যবহার করবে? এটি আমাদের কাছে এখন একটি প্রশ্ন। আমরা অনুসন্ধান করছি, এই পোশাক কাদের জন্য কেনা হয়েছিল, এবং কী উদ্দেশ্যে।”
সীমান্ত পরিস্থিতি সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানাতে গিয়ে সেনা সদর থেকে বলা হয়, “সীমান্তে পুশইন বা জোরপূর্বক অনুপ্রবেশ কোনোভাবেই মেনে নেওয়া হবে না। বিজিবি সেখানে দায়িত্ব পালন করছে, তবে যদি পরিস্থিতি সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপের দাবি করে, তাহলে আমরা যাব। কিন্তু বসে থাকবো—এমনটি ভাবার সুযোগ নেই।”
এই বক্তব্যে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে যে, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, সীমান্ত নিরাপত্তা এবং জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়ে সেনাবাহিনী সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। তারা কেবলমাত্র সামরিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রেই ভূমিকা রাখবে, কোনো রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক উদ্যোগের অংশ হবে না—বিশেষ করে করিডরের মতো কৌশলগত বিষয়ে।
উল্লেখ্য, মিয়ানমারে চলমান সংঘাতের কারণে সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ, গোলাগুলি, এবং মাইন বিস্ফোরণের মতো ঘটনাগুলো বাড়ছে। ইতোমধ্যেই সীমান্তের একাধিক পয়েন্টে অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করা হয়েছে এবং আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে।
এছাড়া চট্টগ্রাম, বান্দরবান ও কক্সবাজার অঞ্চলে KNF ও আরসার মতো গোষ্ঠীগুলোর কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে আনতে সেনাবাহিনী ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সমন্বিতভাবে কাজ করছে। সেনা সদর থেকে বলা হয়েছে, দেশের ভেতরে কোনো সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী গড়ে উঠতে দেওয়া হবে না, এবং কোনো গোষ্ঠী যাতে বিদেশি স্বার্থে দেশের স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে না পারে, সে জন্য সেনাবাহিনী সদা প্রস্তুত রয়েছে।
সার্বিকভাবে বলা যায়, সীমান্ত পরিস্থিতি যতই উত্তেজনাপূর্ণ হোক, সেনাবাহিনী সংবেদনশীল ইস্যুতে জড়িত না হয়ে পেশাদারিত্ব বজায় রেখেই দেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তাদের এই অবস্থান জনমনে আশ্বস্তি জাগিয়েছে, পাশাপাশি রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহলকেও সীমিত রেখেছে করিডর সংক্রান্ত সিদ্ধান্তে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ