
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিপুল অঙ্কের অর্থায়ন প্রয়োজন। তৃতীয় জাতীয় সিদ্ধান্তমূলক পরিকল্পনা (এনডিসি ৩.০) অনুযায়ী, ২০৩৫ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ ৮৪.৯২ মিলিয়ন টন কমানোর লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। তবে এই উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য অর্জনে অন্তত ১১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন পরিবেশ বিষয়ক উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
রবিবার (২১ সেপ্টেম্বর) সকালে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরে আয়োজিত এনডিসি ৩.০ যাচাই কর্মশালায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ তথ্য তুলে ধরেন। কর্মশালায় দেশি-বিদেশি গবেষক, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।
উপদেষ্টা জানান, এনডিসি ৩.০ বাস্তবায়নে মোট ১১৬ বিলিয়ন ডলারের প্রাক্কলিত বিনিয়োগ প্রয়োজন। এর মধ্যে ২৫.৯৫ বিলিয়ন ডলার শর্তহীনভাবে এবং ৯০.২৩ বিলিয়ন ডলার শর্তসাপেক্ষে বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। এই অর্থায়নের মাধ্যমে শর্তহীনভাবে ২৬.৭ মিলিয়ন টন এবং শর্তসাপেক্ষভাবে ৫৮.২ মিলিয়ন টন কার্বন নিঃসরণ কমানো সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, “এনডিসি ৩.০ কেবল কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের পরিকল্পনা নয়; এটি একটি ন্যায়সংগত, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই ভবিষ্যৎ গড়ার প্রতিশ্রুতি। জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় আমাদের উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক কাঠামোকেও সবুজায়নের পথে নিতে হবে।”
রিজওয়ানা হাসান বিশেষভাবে নারী, শিশু, প্রবীণ, প্রতিবন্ধী, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এবং জলবায়ু-অভিবাসীদের অংশগ্রহণের ওপর গুরুত্ব দেন। তিনি উল্লেখ করেন, যেসব জনগোষ্ঠী জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাদের মতামত ও অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন টেকসই হতে পারে না।
তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত কমাতে হলে শুধু প্রযুক্তি ও অর্থায়ন নয়, সামাজিক ন্যায়বিচারও নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার সুরক্ষা এবং তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অপরিহার্য।
উপদেষ্টা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জলবায়ু আন্দোলনে যুক্ত করার ওপর জোর দেন। তার মতে, নবায়নযোগ্য শক্তি প্রকল্প, সবুজ উদ্যোক্তা তৈরি, গবেষণা ও সচেতনতামূলক কর্মসূচির মাধ্যমে তরুণদের যুক্ত করলে বাংলাদেশকে একটি জলবায়ু-সহনশীল রাষ্ট্রে রূপান্তর করা সম্ভব।
তিনি বলেন, “যুবসমাজই আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি। নবায়নযোগ্য জ্বালানি, সবুজ ব্যবসা, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনে তরুণদের সম্পৃক্ত করতে পারলে বাংলাদেশ কেবল জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলায় নয়, বৈশ্বিক সবুজ অর্থনীতিতেও শক্ত অবস্থান তৈরি করতে পারবে।”
রিজওয়ানা হাসান আরও বলেন, স্বাস্থ্য, পানি-স্যানিটেশন, শিক্ষা, খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষি ও অবকাঠামো খাতকে পরিবেশবান্ধব করতে হবে। এজন্য জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় জলবায়ু শিক্ষা ও সবুজ দক্ষতা অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি।
তিনি জানান, জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নবায়নযোগ্য শক্তিতে রূপান্তরের সময় শ্রমিকদের পুনঃপ্রশিক্ষণ দিতে হবে। পাশাপাশি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা নিশ্চিত করা এবং জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর সক্রিয় অংশগ্রহণ ঘটাতে হবে।
কর্মশালায় বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ এবং অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ নাভিদ শফিউল্লাহ।
তারা বলেন, বাংলাদেশ ইতিমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বৈশ্বিক অঙ্গীকার রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। উন্নত দেশগুলোর ন্যায্য অবদান ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদার করার আহ্বান জানান তারা।
কর্মশালার সভাপতি পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. কামরুজ্জামান বলেন, এনডিসি ৩.০ হলো বাংলাদেশের জলবায়ু কৌশলের মূল ভিত্তি। এর সফল বাস্তবায়নের জন্য সরকারি-বেসরকারি খাত, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও নাগরিক সমাজের সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
তিনি বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তর এই পরিকল্পনাকে বাস্তবায়নের রোডম্যাপ তৈরি করছে। সকল অংশীজনকে সঙ্গে নিয়েই এ পরিকল্পনা কার্যকর করতে হবে।
অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা করেন যুগ্ম সচিব ধরিত্রী কুমার সরকার। কর্মশালায় খোলা আলোচনায় দেশি-বিদেশি সরকারি-বেসরকারি সংস্থা, উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান ও পরিবেশ আন্দোলনের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
তারা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত থেকে বাঁচতে বাংলাদেশকে শুধু পরিকল্পনা নয়, বাস্তবায়নের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। এজন্য আন্তর্জাতিক অর্থায়ন, গবেষণা, উদ্ভাবনী প্রযুক্তি এবং জনগণের সচেতনতা একসঙ্গে কাজ করবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ