
ছবি: সংগৃহীত
চূড়ান্ত গেজেট থেকে বাদ পড়া ২২৭ জনের দীর্ঘ আন্দোলনের ফসল হিসেবে অবশেষে ৪৩তম বিসিএসে ১৬২ জন প্রার্থী গেজেটভুক্ত হয়েছেন। মঙ্গলবার (২০ মে) জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত গেজেটে স্বাক্ষর হয় এবং বিকাল পাঁচটার পর সেটি প্রকাশ করা হয়। এর ফলে তাঁরা বিসিএসের বিভিন্ন ক্যাডার পদে সরকারিভাবে নিয়োগ পাওয়ার সুযোগ পেলেন, যা তাঁদের দীর্ঘ সময়ের হতাশা ও প্রতীক্ষার অবসান ঘটালো।
৪৩তম বিসিএসের যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০২০ সালের ৩০ নভেম্বর, যখন বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। এরপর প্রায় চার বছরব্যাপী প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার ধাপ পেরিয়ে ২০২৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর মোট ২,১৬৩ জন প্রার্থীকে বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়। এই সুপারিশের ভিত্তিতে প্রথম গেজেট প্রকাশ করা হয় ২০২৩ সালের ১৫ অক্টোবর, যেখানে ৯৯ জনকে বাদ দিয়ে ২০৬৪ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়।
কিন্তু এতে থেকেই শুরু হয় জটিলতা। নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে যাঁরা স্বাস্থ্য পরীক্ষায় অনুপস্থিত ছিলেন, তাঁদের বাদ দেওয়া হয়। এছাড়া গোয়েন্দা সংস্থার নিরাপত্তা যাচাই প্রতিবেদনে “সাময়িকভাবে অনুপযুক্ত” বিবেচনায় ২২৭ জন প্রার্থীকে সরিয়ে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ৩০ ডিসেম্বর প্রথম প্রজ্ঞাপন বাতিল করে নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করে, যেখানে ১৮৯৬ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয় এবং ২৬৭ জনকে বাদ রাখা হয়।
এই প্রক্রিয়ার বাইরে থাকা ২২৭ জন প্রার্থী এরপর থেকেই নিজ নিজ নির্দোষ প্রমাণে নানামুখী পদক্ষেপ নিতে শুরু করেন। বাদ পড়ার বিরুদ্ধে তাঁরা সংবাদ সম্মেলন, মানববন্ধন ও গণস্বাক্ষর কর্মসূচির আয়োজন করেন। এসব কর্মসূচির মধ্য দিয়ে তাঁরা দাবি জানান—স্বচ্ছ নীতিমালার ভিত্তিতে যাচাই-বাছাই এবং অবিলম্বে গেজেটভুক্তি।
সর্বশেষ ২৯ এপ্রিল থেকে এই বাদপড়া প্রার্থীদের একাংশ রাজধানীতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আমরণ অনশন শুরু করেন। তাঁদের মূল দাবি ছিল—গেজেটভুক্তি ও ভেরিফিকেশন নীতিমালা প্রণয়ন। বেশ কয়েকজন প্রার্থী শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। দেশের বিভিন্ন শিক্ষাবিদ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং সাবেক বিসিএস ক্যাডাররাও তাঁদের দাবির পক্ষে অবস্থান নেন।
এই অনশনের মাধ্যমে গড়ে ওঠে ব্যাপক গণসচেতনতা এবং সরকারে শীর্ষপর্যায় থেকে বিষয়টি আমলে নেওয়া শুরু হয়। পিএসসি ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যৌথ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই শেষে অবশেষে ১৬২ জনকে গেজেটভুক্ত করা হলো।
যদিও গেজেটভুক্ত ১৬২ জন প্রার্থী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন, তবুও বাকি ৬৫ জন প্রার্থী এখনো অন্ধকারে। তাঁদের বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা বা তথ্য জানানো হয়নি। তবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, তাঁদের বিষয়ে এখনো যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ নিরাপত্তা সংস্থার প্রতিবেদনে আপত্তিকর মন্তব্যের কারণে আটকে আছেন, আবার কেউ হয়তো প্রক্রাগত জটিলতার ভুক্তভোগী।
অনেক প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং বিসিএস সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়া আরও স্বচ্ছ ও সময়নিষ্ঠ হওয়া প্রয়োজন, যাতে ভবিষ্যতে এমন অনিশ্চয়তা তৈরি না হয়। কারণ একজন প্রার্থী যখন কঠিন প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হন, তখন শুধুমাত্র অব্যাখ্যাযোগ্য “সাময়িক অনুপযুক্ত” মন্তব্যের ভিত্তিতে তাঁকে বাদ দেওয়ার ঘটনা অসহনীয় হয়ে দাঁড়ায়।
এদিকে গেজেটপ্রাপ্ত ১৬২ জন প্রার্থী তাঁদের আন্দোলনে সহায়তাকারীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। তাঁরা বলছেন, “এটা শুধু আমাদের চাকরি পাওয়ার গল্প নয়, এটা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লড়াই ছিল। আমরা সবাই মিলে প্রমাণ করেছি—দৃঢ় সংকল্প থাকলে অন্যায়কে প্রতিরোধ করা যায়।”
৪৩তম বিসিএসের এই গেজেটজট প্রমাণ করে দিয়েছে যে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় শুধু পিএসসির সুপারিশই যথেষ্ট নয়, বরং প্রশাসনিক পর্যায়ে নীতিগত স্বচ্ছতা ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিও জরুরি। অনেকে বলছেন, এবারই সময় নিরাপত্তা যাচাই প্রক্রিয়ার জন্য একটি নির্দিষ্ট ও গ্রহণযোগ্য গাইডলাইন প্রণয়ন করার, যাতে ভবিষ্যতে আর কাউকে এই ধরনের ‘সাময়িক অনুপযুক্ততার’ নামে অনিশ্চয়তায় পড়তে না হয়।
গেজেটভুক্তির মাধ্যমে যাঁরা অবশেষে স্বপ্নের চাকরি পেলেন, তাঁদের সামনে নতুন অধ্যায় শুরু হলো। তবে যাঁরা এখনও অপেক্ষায়, তাঁদের জন্য লড়াই এখনও শেষ হয়নি। রাষ্ট্র ও প্রশাসনের উচিত হবে—এই অপেক্ষমান প্রার্থীদের বিষয়টি দ্রুত নিষ্পত্তি করে যোগ্যদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ