
ছবি: সংগৃহীত
ইসরাইলি বাহিনীর ঘোষিত ‘সাময়িক মানবিক বিরতি’র ঘোষণার মধ্যেও থামেনি গাজার ওপর সামরিক আগ্রাসন। বরং নতুন করে বেড়েছে হামলা, বেড়েছে লাশের মিছিল। স্থানীয় সময় রোববার (২৭ জুলাই) গাজা উপত্যকার বিভিন্ন এলাকায় চালানো ইসরাইলি হামলায় একদিনেই প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৬৩ জন ফিলিস্তিনি নাগরিক। নিহতদের মধ্যে ৩৪ জন ছিলেন খাদ্য সহায়তার জন্য অপেক্ষমাণ বেসামরিক মানুষ, যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু।
আল জাজিরা ও গাজার স্থানীয় সংবাদসূত্র জানায়, হামলার বড় একটি অংশ চালানো হয়েছে দক্ষিণ গাজার খান ইউনিস এবং বনি সুহেলা এলাকায়। ওই সময় বহু ফিলিস্তিনি নাগরিক জাতিসংঘ ও অন্যান্য মানবিক সংস্থার পক্ষ থেকে বিতরণ করা খাবার সংগ্রহের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাদের ওপরই হঠাৎ করে বিমান হামলা চালায় ইসরাইলি বাহিনী, যেটিকে অনেকেই “ইচ্ছাকৃত হত্যাযজ্ঞ” বলে অভিহিত করেছেন।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য অনুযায়ী, হামলার পর ঘটনাস্থলে শুধু হতাহত মানুষদের কান্না নয়, ছিল ছিন্নভিন্ন শরীর ও রক্তাক্ত কাপড়ের স্তূপ। বেঁচে যাওয়া মানুষদের একজন বলেছেন, “আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম খাবারের জন্য, কিন্তু ওরা বোমা পাঠালো। আমাদের ক্ষুধার প্রতিদান ওরা দিল মৃত্যু দিয়ে।”
এর মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগেই ইসরাইলি সেনাবাহিনী এক ঘোষণায় বলেছিল, তারা প্রতিদিন নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় সাময়িক যুদ্ধবিরতি দেবে, যাতে করে জাতিসংঘ ও অন্যান্য সংস্থা নিরাপদে ত্রাণ সরবরাহ করতে পারে।
তবে বাস্তবে এই বিরতি কতটা কার্যকর তা নিয়ে শুরু থেকেই প্রশ্ন তুলেছিল অধিকারকর্মী ও সাধারণ মানুষ। সেই শঙ্কাই সত্যি হলো রোববার। খাবার সংগ্রহে যাওয়া নিরীহ মানুষকে টার্গেট করে চালানো হামলা আবারও প্রমাণ করল, ‘মানবিক বিরতি’ কেবল আন্তর্জাতিক মহলকে শান্ত রাখার একটি কৌশলমাত্র।
ইসরাইলি বাহিনী দাবি করছে, তারা গাজায় আকাশপথে ত্রাণ সরবরাহ চালু করেছে। শনিবার থেকে বিভিন্ন এলাকায় ‘এয়ারড্রপ’ করা হচ্ছে। রোববারও জর্ডান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত মিলে তিন দফায় প্রায় ২৫ টন খাদ্য ও ওষুধ আকাশপথে গাজায় পাঠিয়েছে বলে জানানো হয়।
কিন্তু বাস্তবতা একেবারে ভিন্ন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) সতর্ক করে জানিয়েছে, গাজায় শিশুরা এখন ভয়ংকর মাত্রায় অপুষ্টিতে ভুগছে। শুধু জুন মাসেই ৫ বছরের নিচে প্রতিটি পাঁচ শিশুর মধ্যে অন্তত একজন মারাত্মক অপুষ্টিতে আক্রান্ত হয়েছে, যা এক মাসেই তিনগুণ বেড়েছে। সংস্থাটি আরও জানিয়েছে, ইচ্ছাকৃতভাবে ত্রাণে বাধা এবং বিলম্বের কারণেই এ অবস্থা তৈরি হয়েছে।
একজন চিকিৎসাকর্মী আল জাজিরাকে বলেন, “আকাশ থেকে ত্রাণ ফেলা হচ্ছে, অথচ মাটিতে ক্ষুধায় শিশু মারা যাচ্ছে। এটি কেমন মানবিক সহায়তা?”
রোববারই হামাস নেতা খলিল আল-হায়া এক বিবৃতি দিয়ে বলেন, “যদি অবরোধ, অনাহার এবং নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড চলতেই থাকে, তাহলে যুদ্ধবিরতির আলোচনার আর কোনো অর্থ থাকে না। ইসরাইল কেবল কথায় বিরতি চায়, কাজে নয়।”
তিনি আরও বলেন, “ফিলিস্তিনিরা শান্তি চায়, তবে অপমানজনকভাবে নয়। আমাদের শিশুদের লাশের ওপর দাঁড়িয়ে কোনো আলোচনা হতে পারে না।”
এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক মঞ্চে যুদ্ধবিরতির জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে বিভিন্ন পক্ষ। তবে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এখনও স্পষ্টভাবে ইসরাইলপন্থী। রোববার ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েনের সঙ্গে এক বৈঠকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেন, “যুদ্ধবিরতির প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে হামাস। তারা জিম্মিদের মুক্তি দিতে রাজি নয়।”
এই বক্তব্য অনেক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ। তাদের মতে, ইসরাইলি আগ্রাসন এবং ৩৬ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনির প্রাণহানির প্রেক্ষাপটে হামাসকে একতরফাভাবে দায়ী করা একটি অমানবিক দৃষ্টিভঙ্গি।
বর্তমানে গাজা এমন এক মানবিক বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে যেখানে প্রতিদিন মৃত্যুর সংখ্যা শুধু পরিসংখ্যান নয়, বরং প্রতিটি পরিবার হারাচ্ছে প্রিয়জন, শিশু হারাচ্ছে তাদের ভবিষ্যৎ, হাসপাতাল হারাচ্ছে চিকিৎসা সামগ্রী, আর জীবন হারাচ্ছে তার স্বাভাবিকতা।
একজন গাজাবাসী নারী বলেন, “আমার তিন সন্তান ছিল। এক মাসে দুজনকে হারিয়েছি। এখন খাবার চাইতে গিয়ে যদি বাকি একজনও হারাই, তবে আর কী বাকি থাকবে?”
জাতিসংঘসহ বিশ্বের প্রভাবশালী মানবাধিকার সংগঠনগুলো ইসরাইলের ওপর চাপ বাড়াতে বিশ্বের দেশগুলোকে সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। তারা বলছে, যুদ্ধবিরতি কেবল কাগজে নয়, বাস্তবে কার্যকর করতে হবে।
গাজার এই মানবিক সংকট প্রতিদিন শুধু মৃত্যু নয়, বিশ্ব বিবেকের জন্য এক অগ্নিপরীক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাময়িক বিরতি নয়—প্রয়োজন পূর্ণ যুদ্ধবিরতি ও অবরোধ প্রত্যাহার। নইলে মানবতা হারিয়ে যাবে ধ্বংসস্তূপের নিচে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ