
ছবি: সংগৃহীত
পুরুষদের মধ্যে একটি সাধারণ কিন্তু নীরব ঘাতক রোগ হচ্ছে প্রোস্টেট ক্যানসার। এটি এমন একটি রোগ, যা অনেক সময় শরীরে ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায় এবং লক্ষণ প্রকাশ না পেয়ে শরীরের গভীরে স্থায়ী ক্ষতি করতে পারে। চিকিৎসা বিজ্ঞান বলছে, বিশ্বজুড়ে পুরুষদের মধ্যে যত ক্যানসার ধরা পড়ে, তার একটি উল্লেখযোগ্য অংশই এই প্রোস্টেট ক্যানসার। বিশেষজ্ঞদের মতে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই ক্যানসারের ঝুঁকিও বৃদ্ধি পায়। ৫০ বছরের পর থেকেই এর সম্ভাবনা প্রবল হয়ে ওঠে। তবে শুধু বয়সই নয়, এই রোগের পেছনে রয়েছে আরও কিছু নির্ধারক— যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে খাদ্যাভ্যাস।
গবেষণায় দেখা গেছে, কিছু কিছু খাবার নিয়মিত খাওয়া প্রোস্টেট গ্রন্থিতে প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে বা হরমোন ভারসাম্যে প্রভাব ফেলতে পারে, যার ফলে ক্যানসার কোষের জন্ম ও বৃদ্ধি সহজ হয়। তাই খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এনে এবং কিছু নির্দিষ্ট খাবার এড়িয়ে চললে অনেকাংশে এই ক্যানসারের ঝুঁকি হ্রাস করা সম্ভব। চলুন জেনে নিই এমন চারটি খাবারের কথা, যেগুলো বিশেষজ্ঞরা প্রোস্টেট ক্যানসারের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করেন।
১. অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন: নীরবভাবে ধ্বংস করছে প্রোস্টেট গ্রন্থি
অনেকেই মনে করেন, মাঝেমধ্যে অ্যালকোহল পান ক্ষতিকর নয়। কিন্তু নিয়মিত বা মাত্রাতিরিক্ত অ্যালকোহল গ্রহণ শরীরে একাধিক ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, যার একটি হচ্ছে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে যাওয়া। গবেষণা বলছে, অ্যালকোহল প্রোস্টেট গ্রন্থিতে প্রদাহের সৃষ্টি করে এবং হরমোন ভারসাম্যে বিঘ্ন ঘটায়, যা ক্যানসার সৃষ্টির একটি বড় কারণ।
বিশেষ করে যারা দিনে একাধিকবার অ্যালকোহল পান করেন বা সপ্তাহে কয়েকবার হেভি ড্রিংক করেন, তাদের প্রোস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি অনেক গুণ বেড়ে যায়। এ ছাড়া অ্যালকোহল যকৃতের কর্মক্ষমতা কমিয়ে দেয়, ফলে টক্সিন শরীরে জমতে থাকে, যা কোষের জিনগত গঠন নষ্ট করে দিয়ে ক্যানসার কোষের জন্ম দেয়।
২. ট্রান্স ফ্যাট: আপনার প্রতিদিনের স্ন্যাকসেই লুকিয়ে থাকতে পারে বিপদ
সাধারণত বেকড পণ্য যেমন— কুকিজ, প্যাস্ট্রি, কেক, বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত ভাজা খাবার এবং প্যাকেটজাত স্ন্যাকসে প্রচুর ট্রান্স ফ্যাট থাকে। এই ফ্যাট শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। বিশেষ করে এটি শরীরে দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ সৃষ্টি করে এবং শরীরের হরমোন নিঃসরণ প্রক্রিয়ায় বিঘ্ন ঘটায়, যা প্রোস্টেট কোষকে ক্যানসারে রূপান্তরিত করতে পারে।
ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশন জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়, নিয়মিতভাবে ট্রান্স ফ্যাট গ্রহণ করলে শুধু প্রোস্টেট নয়, আরও কয়েক ধরনের ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি বহুগুণে বেড়ে যায়। তাই প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় থাকা ট্রান্স ফ্যাটসমৃদ্ধ খাবার যতটা সম্ভব বর্জন করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
৩. উচ্চ চর্বিযুক্ত দুগ্ধজাত পণ্য: দুধ খাওয়ার আগে ভাবুন দু’বার
অনেকেই ধারণা করেন, দুধ বা দই খাওয়া খুবই উপকারী। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, বিশেষ করে পুরুষদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত দুধ বা দুগ্ধজাত পণ্য যেমন— ফুল ফ্যাট দুধ, মাখন, ক্রিম ও পনির ইত্যাদি প্রোস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। এতে থাকা স্যাচুরেটেড ফ্যাট ও কৃত্রিম হরমোন শরীরে এমন এক পরিবেশ তৈরি করে, যা ক্যানসার কোষের বৃদ্ধিকে উৎসাহ দেয়।
২০০১ সালে হার্ভার্ড পাবলিক হেলথ স্কুলের এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা দিনে দুই গ্লাস বা তার বেশি ফুল ফ্যাট দুধ পান করেন, তাদের প্রোস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি যারা দুধ পান করেন না বা অল্প পরিমাণে পান করেন, তাদের তুলনায় প্রায় ৬০ শতাংশ বেশি।
৪. রেড মিট ও প্রক্রিয়াজাত মাংস: ক্যানসারের চূড়ান্ত ঝুঁকিপূর্ণ উৎস
প্রোস্টেট ক্যানসারের অন্যতম প্রধান ঝুঁকির উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয় গরুর মাংস, খাসি, শুয়োরের মাংস এবং এসব প্রাণীর তৈরি সসেজ, হট ডগ ও অন্যান্য প্রক্রিয়াজাত মাংসকে। গবেষকরা জানান, উচ্চ তাপে রান্না করা লাল মাংসে হেটেরোসাইক্লিক অ্যামাইনস (HCAs) ও পলিসাইক্লিক অ্যারোমেটিক হাইড্রোকার্বনস (PAHs) নামক ক্ষতিকর রাসায়নিক উৎপন্ন হয়, যা কোষের ডিএনএ পরিবর্তন করে এবং ক্যানসার ডেকে আনে।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যানসার ইনস্টিটিউট এক জরিপে জানায়, যেসব পুরুষ নিয়মিত লাল মাংস খান, তাদের মধ্যে আক্রমণাত্মক প্রোস্টেট ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি।
স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনই রক্ষা করতে পারে
প্রোস্টেট ক্যানসার কোনো একটি নির্দিষ্ট কারণেই হয় না। এটি একটি বহুস্তর বিশিষ্ট রোগ, যার পেছনে বয়স, জিনগত বৈশিষ্ট্য, জীবনধারা এবং খাদ্যাভ্যাস— সবই একত্রে কাজ করে। তবে খাদ্যাভ্যাস এমন একটি বিষয়, যেটি আপনি নিজের ইচ্ছায় পরিবর্তন করতে পারেন। তাই এখন থেকেই সচেতন হয়ে উপরের এই চার ধরনের খাবার যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলুন।
সঙ্গে নিয়মিত শরীরচর্চা করুন, পর্যাপ্ত পানি পান করুন, স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ করুন এবং বছরে অন্তত একবার প্রোস্টেট পরীক্ষা করান। মনে রাখবেন, সচেতনতাই হতে পারে আপনার জীবনের সবচেয়ে বড় সুরক্ষা।
তথ্যসূত্র: হার্ভার্ড হেলথ পাবলিকেশন, ইউএস ন্যাশনাল ক্যানসার ইনস্টিটিউট, জার্নাল অফ ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশন, হেলথলাইন
বাংলাবার্তা/এমএইচ