ছবি:ডা: সানজিদা সরকার স্বর্ণা
বাসা বদল করছিলাম বেশ কয়েক বছর আগে! চার-পাঁচজন শ্রমিক ঠিক করেছিলাম,বাসার ভারী ভারী সব আসবাবপত্র বইতে গিয়ে তাদের শরীরের প্রতিটা কোষ থেকে ঘাম ঝরছিল! সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে নিঃশব্দে ক্লান্তির শ্বাস ফেলছিলেন তারা,তাদের ঘামে ভেজা শার্টের দিকে তাকিয়ে আমার বুকের পাঁজর ছিঁড়েও বেরিয়ে এসেছিল একটা দীর্ঘশ্বাস, তবে তা ক্লান্তির নয়,গোপন এক দুঃখবোধের!
এই ঘামে ভেজা প্রতিটা পুরুষের একেকটা পরিবার আছে!পরিবারের দায় কাঁধে নিয়েছে বলেই তো নিঃশব্দে অজস্র ক্লান্তি বয়ে বেড়ায় তারা! আমি জানি,তাদের এই ক্লান্তিটুকু পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্রতম এক অপার্থিব ব্যপার! পরিবারের দায় কাঁধে নেওয়া এই পুরুষগুলো ভালো থাকুক!
দূরপাল্লার বাসে রংপুর থেকে ময়মনসিংহ ফিরছিলাম!তখন মধ্যরাত,শীতকাল আধিপত্য বিস্তার করেছে চারপাশে!হাইওয়েতে টোলঘরের সামনে চাদর মুড়ি দিয়ে দাঁড়িয়ে গাড়ি থেকে টোল সংগ্রহ করছে একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষ!
আমাদের গাড়ির হেল্পার গলা খাঁকারি দিয়ে বললো অনেক রাত হয়েছে,হিম পড়েছে খুব,যান বাসায় গিয়ে লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে থাকুন! আমি জানি,সেই পুরুষটি কারো স্বামী কিংবা কারো বাবা! তাদের মুখে অন্নের যোগান দিতে শীতের রাতেও কষ্ট করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে তাকে!
ঐ পুরুষ মানুষটির যত্ন নিও বিধাতা!
জয়নাল আবেদিন পার্ক এর ভেতর তিন মিটার লম্বা আর দুই মিটার প্রস্থের এক ছোট্ট দোকানে পান,সিগারেট বিক্রি করতো এক বৃদ্ধ দোকানী! তার শরীরে বয়সের অসংখ্য ভাঁজ,চোখে-মুখে ক্লান্তির রেখা! শুধু নিজের পেটের জন্য তো নয়,সে নিশ্চয়ই আরো কিছু মানুষের পেটে অন্নের যোগান দেয়! তাই জীবনের ক্রান্তিলগ্নে এসেও তাকে পরিশ্রম করে যেতে হচ্ছে রোজ! অথচ তার এখন বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম নেবার কথা ছিলো! ঐ বৃদ্ধ পুরুষ মানুষটিকে আমার সশ্রদ্ধ সালাম!
একদিন রিক্সা চড়ে ঘরে ফিরছিলাম রাতের বেলা। মধ্যবয়স্ক রিক্সাচালকটার গেঞ্জিতে কয়েক জায়গায় ছিঁড়ে যাওয়া চিহ্ন, যেন দারিদ্র্যতা এসে উপহাস করছে সর্বাঙ্গে! গল্পে গল্পে জানলাম,সেই দরিদ্র বাবা তার সামান্য উপার্জন দিয়ে তিন সন্তানকে স্কুলে পড়াচ্ছেন,তিনি চান না তার মতো দরিদ্র জীবন বয়ে বেড়াক তার সন্তানেরা! ঐ রিক্সাচালক বাবা নামক পুরুষটি খুব ভালো থাকুক,যে কিনা তার সন্তানদের পড়ার খরচ চালাতে গিয়ে দিনের পর দিন ছেঁড়া গেঞ্জি পরে হাসিমুখে প্যাডেল ঘোরাতে থাকে!
একদিন বাসার দরজায় কড়া নাড়ল এক আগন্তুক! দরজা খুলে দেখি অসহায় মুখে দাঁড়ানো একজন ক্লান্ত বাবা! যে কিনা সবার দোরগোড়ায় হাত পাতছে মেয়ের বিয়ের যৌতুকের টাকা যোগাড় করার জন্য! মানসম্মান ব্যাগে পুড়ে রেখে মাথা নুইয়ে যেই বাবা নামের পুরুষটি সন্তানের জন্য এভাবে হাত পাতার ক্ষমতা রাখে,সেই পুরুষটি থাকুক আমার শ্রদ্ধায়!
সন্তানকে ছোটবেলায় ফেলে রেখে এক মা চলে গেল তার প্রেমিকের হাত ধরে! বাবা আর দ্বিতীয় বিয়ে করলেন না,যদি সন্তানদের প্রতি অবহেলা করা হয়! অপরিপক্ক সেই মানুষটা বাচ্চা লালন পালন করা শিখে গেল,মায়ের মতো করে আগলে রাখতে শুরু করলো! রান্নাটাও শিখে নিলো একটু একটু করে,একসাথে মা-বাবা দু'জনেরই দায়িত্ব পালন করা সেই মহান পুরুষটি আমার স্মৃতিতে জেগে থাকুক সারা জীবন!
রাস্তা পাড় হবার সময় প্রতিবার খুব খেয়ালে প্রেমিক পাশে এসে দাঁড়ায়, যেই পাশ থেকে গাড়ি আসে ঠিক সেই পাশে, তারপর প্রেমিকার হাত ধরে রাস্তা পাড় হয়! নিঃশ্চুপ গোপনে অ-প্রকাশিত এই খেয়াল রাখা প্রেমিক নামক পুরুষদের যত্নেরেখো প্রিয় শহর!
সারা মাসের ঘামঝরা উপার্জন দিয়ে কী ভীষণ আনন্দে শাড়ি কিনে ঘরে ফিরে মধ্যবিত্ত এক স্বামী,যে কিনা স্বামীর চেয়ে বন্ধু কিংবা প্রেমিকই বেশি! সেই পুরুষ মানুষটি ভালো থাকুক যত্নে রাখা প্রিয় রুমালের মতো!
সহধর্মিণী অসুস্থ বলে সারাদিন অফিস করে যেই পুরুষ সারারাত জেগে তার প্রিয় নারীটির সেবা করে যায়,সেই পুরুষটি বেঁচে থাকুক দীর্ঘ জীবন!
এই প্রেম, অ-প্রেমের শহরে সত্যিকারের পুরুষেরা অক্ষয় হয়ে থাকুক প্রেমিকার চোখের কাজলে,অ্যালকোহলিক প্রেমে! এই পুরুষেরা যত্নে থাকুক মায়ের আঁচলে জমানো সবটুকু খাঁটি ভালোবাসায়,শ্রদ্ধায় থেকো প্রিয় পুরুষ!
লেখক: পিএইচডি স্কলার ইংল্যান্ড