
ছবি: সংগৃহীত
দেশব্যাপী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা ব্যবস্থায় গতি ফিরিয়ে আনতে এবং শিক্ষার মানোন্নয়নে প্রধান শিক্ষকের দীর্ঘদিনের শূন্য পদ পূরণে বড় ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রশাসনিক কাঠামো ও পরিচালনায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী প্রধান শিক্ষকদের প্রায় অর্ধেক পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য থাকায় দেশের প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছিল।
এই প্রেক্ষাপটে শিক্ষার ভিত্তি মজবুত করতে এবং বিদ্যালয়ের নেতৃত্ব কাঠামো সুসংহত করতে সরকার ৩৪ হাজার ১০৬টি শূন্য প্রধান শিক্ষক পদ দ্রুত পূরণের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এ সংক্রান্ত একটি বিস্তারিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তি মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো হয়।
প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৬৫ হাজার ৫৬৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিপরীতে অনুমোদিত প্রধান শিক্ষক পদের সংখ্যা ৬৫ হাজার ৫০২টি। অথচ বর্তমানে এসব পদের মধ্যে কর্মরত আছেন মাত্র ৩১ হাজার ৩৯৬ জন প্রধান শিক্ষক। ফলে মোট শূন্য পদ দাঁড়িয়েছে ৩৪ হাজার ১০৬টি, যা সারাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা খাতের জন্য এক বিশাল চ্যালেঞ্জ।
প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শুধু শ্রেণি-পাঠদানেই নয়, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, পাঠ পরিকল্পনা, বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং শিক্ষার্থীদের মনোবিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ফলে দীর্ঘদিন প্রধান শিক্ষক না থাকায় বিদ্যালয়গুলো কার্যত প্রশাসনিক নেতৃত্বহীন হয়ে পড়ছে।
শূন্য ৩৪ হাজার পদের মধ্যে ২ হাজার ৬৪৭টি পদ সরাসরি নিয়োগযোগ্য ধরা হয়েছে। এই পদের মধ্যে ১০ শতাংশ সংরক্ষিত রেখে বাকি ২ হাজার ৩৮২টি পদে নতুন করে সরাসরি নিয়োগের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে মন্ত্রণালয়।
এই লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) সচিবালয়ে ইতোমধ্যে চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে। খুব শিগগিরই এসব পদে নিয়োগের জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করবে পিএসসি, এমনটি জানানো হয়েছে মন্ত্রণালয় থেকে।
পিএসসি সাধারণত প্রথম শ্রেণির গেজেটেড পদে নিয়োগ দিয়ে থাকে, তবে শিক্ষা ও প্রশাসনিক গুরুত্ব বিবেচনায় প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষক নিয়োগে তাদের সম্পৃক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
সরকার সরাসরি নিয়োগের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ পদোন্নতির মাধ্যমেও প্রধান শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, জাতীয়করণকৃত শিক্ষকদের গ্রেডেশন সংক্রান্ত ৭৩/২০২৩ নম্বর সিভিল আপিল মামলার নিষ্পত্তি হলে ৩১ হাজার ৪৫৯টি পদে সহকারী শিক্ষক থেকে পদোন্নতির মাধ্যমে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হবে।
এই মামলাটি দীর্ঘদিন ধরে প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে একটি বড় আইনি জটিলতা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মামলার নিষ্পত্তির পরই সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের মধ্যে পদোন্নতির সুযোগ সৃষ্টি হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই নিয়োগ কার্যক্রম সম্পন্ন হলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর জনবল ঘাটতি অনেকটাই পূরণ হবে। ফলে বিদ্যালয়গুলোর দৈনন্দিন পরিচালনা, পাঠদান পরিবেশ ও শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশে উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রধান শিক্ষক নিয়োগ কেবল প্রশাসনিক পূরণের বিষয় নয়, এটি শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য কাঠামোগত ভিত্তি তৈরির অংশ। বিদ্যালয় পর্যায়ে যোগ্য ও অভিজ্ঞ নেতৃত্ব থাকলে সার্বিক শিক্ষার পরিবেশ উন্নত হয় এবং শিশুরা আরও আগ্রহী হয়ে ওঠে স্কুলমুখী হতে।
সরকারের লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) অংশ হিসেবে সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা। এই লক্ষ্য পূরণে বিদ্যালয়ের নেতৃত্ব কাঠামো পুনর্গঠন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই), জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি (নেপ) এবং জেলা-উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে এই বিশাল নিয়োগ ও পদোন্নতির প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করা হবে।
প্রাথমিক শিক্ষকদের বিভিন্ন সংগঠনও দীর্ঘদিন ধরে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতি প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্নের দাবি জানিয়ে আসছিল। এখন সরকারের এই পদক্ষেপ বাস্তবায়ন হলে প্রাথমিক শিক্ষায় কাঙ্ক্ষিত মান অর্জনের পথ সুগম হবে বলে আশাবাদ প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ