
ছবি: সংগৃহীত
ঢাকার কাস্টমস হাউসের প্রিভেন্টিভ টিম সম্প্রতি এক গোপন তথ্যের ভিত্তিতে পরিচালিত বিশেষ অভিযানে বিপুল পরিমাণ আমদানি নিষিদ্ধ সিগারেট স্ট্যাম্প ও মোবাইল ফোনের LCD স্ক্রিন জব্দ করেছে। এই অভিযানটি পরিচালিত হয় ২২ সেপ্টেম্বর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের এয়ারফ্রেইট আমদানি কার্গো শাখায়, যেখানে কাস্টমস হাউসের প্রিভেন্টিভ টিমের সঙ্গে এয়ারফ্রেইট ইউনিটও সহযোগিতা করে।
কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, অভিযানে দুইটি আলাদা এয়ারওয়ে বিলের মাধ্যমে বন্ড সুবিধায় ঘোষিত গার্মেন্টস এক্সেসরিজের চালানের মধ্যে গোপনে এসব নিষিদ্ধ পণ্য আনার চেষ্টা করা হয়। ঘোষণায় দেখানো হয়েছিল যে চালানে রয়েছে পেপার লেবেল, গাম টেপ এবং লেইস জাতীয় পণ্য। কিন্তু কাস্টমস কর্মকর্তাদের সন্দেহ হওয়ায় পণ্য খালাসের আগে সেটি তল্লাশি করা হয়। তল্লাশিতে প্রকাশ পায়, ঘোষণার বাইরে প্রায় ৯৬ লাখ পিস সিগারেট স্ট্যাম্প এবং ২২২ কেজি ওজনের মোবাইল ফোনের LCD আমদানি করার চেষ্টা হয়েছে।
এই চোরাচালানের মূল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে গাজীপুরের পূবাইল এলাকার একটি গার্মেন্টস এক্সেসরিজ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ‘মাহাদী ফ্যাশন (প্রা. লি.)’। প্রতিষ্ঠানটি চীনের গুয়াংঝু থেকে প্রায় তিন টন ওজনের পণ্য আমদানি করেছে বলে ঘোষণা দিয়েছিল। তাদের মনোনীত সিএন্ডএফ (ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং) এজেন্ট ‘সিটি এয়ার লাইনস’ এই চালান আমদানির প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার দায়িত্বে ছিল। কিন্তু তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, আমদানিকারক ও এজেন্ট উভয়েই যোগসাজশে ঘোষণার বাইরে নিষিদ্ধ সিগারেট স্ট্যাম্প এবং মোবাইল LCD খালাসের অপচেষ্টা করে।
কাস্টমস কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এই বিপুল পরিমাণ সিগারেট স্ট্যাম্প যদি বাজারে প্রবেশ করত, তবে তা অবৈধভাবে সিগারেট সরবরাহে ব্যবহার করা হতো। এর ফলে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হতো প্রায় ৯৪ কোটি টাকা। এ কারণে আটককৃত পণ্যগুলো বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে এবং আমদানিকারক ও তাদের সিএন্ডএফ এজেন্টের বিরুদ্ধে শুল্ক আইন অনুযায়ী মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, সংগঠিত চোরাচালান চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে গার্মেন্টস এক্সেসরিজ ঘোষণার আড়ালে নিষিদ্ধ ও উচ্চমূল্যের পণ্য দেশে আনার চেষ্টা করে আসছে। বিশেষ করে বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করে তারা কোটি কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে আসছে। এই ঘটনায় চোরাচালান চক্রের বিস্তৃত নেটওয়ার্ক, তাদের বিদেশি সংযোগ, এবং স্থানীয়ভাবে কাদের সহায়তায় এমন কর্মকাণ্ড সম্ভব হয়েছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
কাস্টমস হাউসের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, “আমরা গোয়েন্দা তথ্য পেয়েছিলাম যে সাম্প্রতিক কিছু চালানে ঘোষণার বাইরে উচ্চ শুল্কযুক্ত ও নিষিদ্ধ পণ্য আনার চেষ্টা হচ্ছে। এ কারণেই আমরা বিশেষ নজরদারি চালাই। আমাদের ধারণা, এটি একটি আন্তর্জাতিক চোরাচালান চক্রের সঙ্গে জড়িত।” তিনি আরও বলেন, এ ধরনের অপকর্ম রোধে এয়ারফ্রেইট শাখায় নজরদারি আরও কঠোর করা হবে।
এদিকে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সিগারেট স্ট্যাম্প জব্দ হওয়া মানে শুধু রাজস্ব ক্ষতি নয়, বরং সিগারেট শিল্পে অবৈধ প্রতিযোগিতা এবং জনস্বাস্থ্যের জন্যও এটি ভয়াবহ হুমকি। কারণ অবৈধভাবে বাজারে প্রবেশ করা সিগারেট সরকার নির্ধারিত মূল্য ও কর ব্যবস্থার বাইরে বিক্রি হয়, যা একদিকে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি করে, অন্যদিকে সাধারণ ভোক্তাদের প্রতারণার শিকার করে।
এই ঘটনায় ব্যবসায়ী মহলেও আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। আইন মেনে বৈধভাবে পণ্য আমদানি করা ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ ধরনের চোরাচালান বন্ধ না হলে তাদের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং সরকারের আস্থা হারাবে।
বর্তমানে আটককৃত পণ্যের পরিমাণ নিরূপণ ও সঠিক তদন্তের জন্য কাস্টমসের বিশেষ টাস্কফোর্স কাজ করছে। শিগগিরই আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক এবং সংশ্লিষ্ট সিএন্ডএফ এজেন্টকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হবে বলে জানা গেছে।
সবমিলিয়ে এই অভিযানকে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ একটি বড় ধরনের সাফল্য হিসেবে দেখছে। তাদের দাবি, এতে করে শুধু শত কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি রোধ হয়নি, বরং আন্তর্জাতিক চোরাচালান চক্রের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থানও আবারও প্রমাণিত হলো।
বাংলাবার্তা/এসজে