
ছবি: সংগৃহীত
ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রশ্নটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বহু দশক ধরে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে। দীর্ঘ সময় ধরে চলমান এই বিতর্ক আবারও নতুন মাত্রা পেয়েছে ফ্রান্স ও সৌদি আরবের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত বহুজাতিক সম্মেলনের মাধ্যমে। সোমবার (২২ সেপ্টেম্বর) অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে অন্তত কয়েক ডজন দেশের শীর্ষ নেতা অংশ নিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন নেতা ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা দেন। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই সম্মেলন ফিলিস্তিনকে আন্তর্জাতিক কূটনীতির অগ্রভাগে নিয়ে এসেছে।
গত রবিবার যুক্তরাজ্য, কানাডা, পর্তুগাল ও অস্ট্রেলিয়া একযোগে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা দেয়। পরদিন অর্থাৎ সোমবার আরও ছয়টি দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার অঙ্গীকার করে। এই তালিকায় রয়েছে বেলজিয়াম, ফ্রান্স, লুক্সেমবার্গ, মাল্টা, স্যান ম্যারিনো এবং অ্যান্ডোরা। এর ফলে জাতিসংঘের মোট ১৫১টি সদস্য রাষ্ট্র ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। মঙ্গলবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বিশ্বনেতাদের ভাষণের আগেই এসব ঘোষণা আসতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এতে করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ফিলিস্তিনের স্বীকৃতি পাওয়ার চাপ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও এই স্বীকৃতির তাত্ক্ষণিক আইনি ও কূটনৈতিক মূল্য সীমিত, তবুও এর প্রতীকী গুরুত্বকে আন্তর্জাতিক মহল অবহেলা করতে পারছে না।
ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার ধারাবাহিকতায় তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এক মুখপাত্র স্বীকৃতির এই ঢলকে ‘লোক-দেখানো’ পদক্ষেপ হিসেবে অভিহিত করেছেন। এএফপিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমাদের মনোযোগ সিরিয়াস কূটনীতির ওপর, কেবলমাত্র দেখানোর জন্য গৃহীত পদক্ষেপের ওপর নয়।”
অন্যদিকে ইসরায়েল এই স্বীকৃতিগুলোকে তাদের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে দেখছে। তারা মনে করে, এই স্বীকৃতি আন্তর্জাতিকভাবে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনকে বৈধতা দিচ্ছে এবং ইসরায়েলি অবস্থানকে দুর্বল করছে।
বাস্তবে ফিলিস্তিনের রাষ্ট্র হিসেবে অবস্থান এখনো পূর্ণাঙ্গ নয়। জাতিসংঘে ফিলিস্তিন এখনো পূর্ণ সদস্য নয়, বরং পর্যবেক্ষক মাত্র। তাদের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সীমানা, রাজধানী কিংবা সেনাবাহিনী নেই। ফলে স্বীকৃত দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক চালানোর ক্ষেত্রেও নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে বিদেশি রাষ্ট্রগুলো কূটনৈতিক মিশন স্থাপন করতে গেলেও নানা জটিলতায় পড়তে হয়।
তবুও ফিলিস্তিন একটি আধারাষ্ট্র হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজস্ব অবস্থান ধরে রেখেছে। তাদের নিজস্ব কূটনৈতিক মিশন আছে, তারা আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় এবং বহু আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্য হিসেবেও কাজ করছে।
ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রশ্নটি নতুন নয়। ১৯১৭ সালের বেলফোর ঘোষণা থেকেই এই অঞ্চল আন্তর্জাতিক রাজনীতির অসমাপ্ত ইস্যু হয়ে আছে। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলেও ফিলিস্তিনের সমান্তরাল রাষ্ট্র গঠনের প্রচেষ্টা বারবার ব্যর্থ হয়েছে। বারবার আলোচনার টেবিলে আসা সত্ত্বেও রাজনৈতিক সমাধান অচলাবস্থার মধ্যেই রয়ে গেছে। আজকের দিনে এসে তিন-চতুর্থাংশ দেশ ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
ফ্রান্সের অ্যাইক্স-মার্সেইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক আইন বিভাগের অধ্যাপক রোঁমা লে বোফে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতিকে আন্তর্জাতিক আইনের অন্যতম জটিল প্রশ্ন হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। তাঁর মতে, স্বীকৃতি মূলত রাজনৈতিক ও প্রতীকী গুরুত্ব বহন করে। এটি প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ—উভয়ভাবেই হতে পারে। তিনি বলেন, “স্বীকৃতি দেওয়া মানেই নতুন একটি রাষ্ট্র তৈরি হয়েছে—এমন নয়। আবার স্বীকৃতি না দেওয়া মানেই রাষ্ট্রের অস্তিত্ব নেই, সেটাও সঠিক নয়।”
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে সিঙ্গাপুরের ঘোষণা। দেশটি জানিয়েছে, তারা ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারী গোষ্ঠীর নেতাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে এবং সঠিক সময়ে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেবে। সিঙ্গাপুরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভিভিয়ান বালাকৃষ্ণান সংসদে বলেন, “আমরা ইসরায়েলি সরকারের কাছে বসতি নির্মাণ ও সম্প্রসারণ বন্ধ করার আহ্বান জানাচ্ছি।” তিনি সতর্ক করে বলেন, ই-১ বসতি প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে পশ্চিম তীর খণ্ডিত হয়ে পড়বে।
ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি এখন শুধু মধ্যপ্রাচ্যের নয়, বৈশ্বিক রাজনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়। স্বীকৃতি পাওয়ার এই ধারা নিঃসন্দেহে ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক অবস্থানকে শক্তিশালী করছে। যদিও তাৎক্ষণিকভাবে বড় কোনো পরিবর্তন আসবে না, তবে দীর্ঘমেয়াদে এই স্বীকৃতির ঢেউ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির সমীকরণ বদলে দিতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ