
ছবি: সংগৃহীত
ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বীকৃতি দেওয়ার সংগ্রাম বহু দশক ধরে চলমান। একসময় মনে করা হতো কেবল আরব, আফ্রিকান ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলোই ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দৃশ্যপট নাটকীয়ভাবে বদলাতে শুরু করেছে। বিশেষত পশ্চিমা বিশ্বের প্রভাবশালী কয়েকটি দেশের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত এই বিতর্ককে এক নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছে।
রোববার (২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫) যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া একযোগে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা দেয়। এর অল্প সময়ের মধ্যেই পর্তুগালও একই পদক্ষেপ নেয়। চলতি বছরের মার্চে মেক্সিকো ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। শিগগিরই ফ্রান্সও একই ঘোষণা দিতে চলেছে বলে দেশটির নীতিনির্ধারকরা নিশ্চিত করেছেন। এই ধারাবাহিক পদক্ষেপে বোঝা যাচ্ছে, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার যেসব দেশ এতদিন ফিলিস্তিন নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল, তারাও এখন ধীরে ধীরে দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানের প্রতি ঝুঁকছে।
জাতিসংঘের ১৯৩ সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে ইতোমধ্যেই ১৫১টি দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এর ফলে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অঙ্গনে ফিলিস্তিনের অবস্থান আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। যদিও জাতিসংঘে ফিলিস্তিন এখনো পূর্ণ সদস্য নয়, কেবল পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত; তবুও এই বিস্তৃত সমর্থন ফিলিস্তিনের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিকে বৈশ্বিকভাবে বৈধতা দিচ্ছে।
বাংলাদেশ ফিলিস্তিন প্রশ্নে সবসময়ই একটি সুস্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে। ১৯৮৮ সালের ১৫ নভেম্বর ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ঘোষণা দেওয়ার পর পরদিনই, অর্থাৎ ১৬ নভেম্বর ১৯৮৮, বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান করে। স্বাধীনতার পর থেকেই ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রামে বাংলাদেশের অটল সমর্থন ছিল, যা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক রূপ পায়।
ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রক্রিয়াটি কয়েক দশক ধরে চলমান। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে স্বীকৃতি আসতে থাকে।
-
২০২৫: পর্তুগাল, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, মেক্সিকো।
-
২০২৪: আর্মেনিয়া, স্লোভেনিয়া, আয়ারল্যান্ড, নরওয়ে, স্পেন, বাহামা, ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগো, জ্যামাইকা, বার্বাডোজ।
-
২০১৯: সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস।
-
২০১৮: কলম্বিয়া।
-
২০১৫: সেন্ট লুসিয়া, হলি সি।
-
২০১৪: সুইডেন।
-
২০১৩: গুয়াতেমালা, হাইতি।
-
২০১২: থাইল্যান্ড।
-
২০১১: আইসল্যান্ড, ব্রাজিল, গ্রানাডা, অ্যান্টিগুয়া অ্যান্ড বারবুডা, ডমিনিকা, বেলিজ, সেন্ট ভিনসেন্ট, হন্ডুরাস, এল সালভাদর, সিরিয়া, দক্ষিণ সুদান, লাইবেরিয়া, লেসোথো, উরুগুয়ে, প্যারাগুয়ে, সুরিনাম, পেরু, গায়ানা, চিলি।
-
২০১০: আর্জেন্টিনা, ইকুয়েডর, বলিভিয়া।
-
২০০৯: ভেনেজুয়েলা, ডমিনিকান প্রজাতন্ত্র।
-
২০০৮: আইভরি কোস্ট, লেবানন, কোস্টারিকা।
-
২০০৬: মন্টেনেগ্রো।
-
২০০৪: পূর্ব তিমুর।
-
১৯৯৮: মালাউয়ি।
-
১৯৯৫: দক্ষিণ আফ্রিকা, কিরগিজস্তান, পাপুয়া নিউগিনি।
-
১৯৯৪: উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান।
-
১৯৯২: বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা, জর্জিয়া, তুর্কমেনিস্তান, আজারবাইজান, কাজাখস্তান।
-
১৯৯১: ইসওয়াতিনি।
-
১৯৮৯: ফিলিপাইন, ভানুয়াতু, বেনিন, ইকুয়েটরিয়াল গিনি, কেনিয়া, ইথিওপিয়া, রুয়ান্ডা।
-
১৯৮৮: রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, চীন, ভারত, নেপাল, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান, ভুটান, ভিয়েতনাম, কাতার, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, আলজেরিয়া, বাহরাইন, ইন্দোনেশিয়া, ইরাক, কুয়েত, লিবিয়া, মালয়েশিয়া, তিউনিসিয়া, তুরস্ক, ইয়েমেন, মরক্কো, ইরান, ওমান, পোল্যান্ড, বেলারুশ, ইউক্রেন, বুরুন্ডি, বতসোয়ানা, গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কঙ্গো, গ্যাবন, সাও তোমে অ্যান্ড প্রিন্সেপ, মোজাম্বিক, অ্যাঙ্গোলা, কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, সিয়েরা লিওন, উগান্ডা, লাওস, চাদ, ঘানা, টোগো, জিম্বাবুয়ে। একই বছর সাইপ্রাস, চেক প্রজাতন্ত্র, মিশর, গাম্বিয়া, নাইজেরিয়া, সিশেলস, স্লোভাকিয়া, আলবেনিয়া, ব্রুনেই, জিবুতি, মরিশাস, সুদান, কিউবা, জর্ডান, মাদাগাস্কার, নিকারাগুয়া, সার্বিয়া, জাম্বিয়া, মৌরিতানিয়া, সোমালিয়া, বুলগেরিয়া, কেপ ভার্দে, নাইজার, রোমানিয়া, তানজানিয়া, হাঙ্গেরি, মঙ্গোলিয়া, সেনেগাল, বুরকিনা ফাসো, কম্বোডিয়া, কমোরোস, গিনি, মালি, গিনি বিসাউ, নামিবিয়া, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র—সব মিলিয়ে ৮০টিরও বেশি দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়।
বিশ্লেষকদের মতে, এই স্বীকৃতিগুলো কেবল কূটনৈতিক আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং এক ধরনের রাজনৈতিক ও নৈতিক অবস্থানও বটে। আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে স্বীকৃতি মানেই নতুন রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে—এমন নয়। তবে স্বীকৃতির মাধ্যমে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে বৈধতা দেওয়া হয়, যা ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের সমাধানে আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করে।
আজ পর্যন্ত ১৫১টি দেশ ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, যা জাতিসংঘের প্রায় চার-পঞ্চমাংশ সদস্য। এই সংখ্যাটি কেবল বাড়ছেই। পশ্চিমা দেশগুলোর নতুন উদ্যোগ নিঃসন্দেহে ফিলিস্তিন প্রশ্নকে নতুন দিগন্তে নিয়ে যাচ্ছে। এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো—জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্যপদ ও কার্যকর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি কবে পাবে ফিলিস্তিন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ