
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশে সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহন ও নৌপরিবহন খাতকে আরও শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বড় জাহাজ আমদানিতে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট অব্যাহতির ঘোষণা দিয়েছে। ২০২৬ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত এই সুবিধা কার্যকর থাকবে। তবে এ সুযোগ নিতে হলে আমদানিকারকদের সাতটি কঠোর শর্ত পূরণ করতে হবে। এসব শর্ত মানা না হলে অব্যাহতি বাতিল হওয়ার ঝুঁকি থাকবে।
সম্প্রতি এনবিআরের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে এই সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, শুধুমাত্র ৫ হাজার ডিডব্লিউটি (ডেড ওয়েট টন) ধারণক্ষমতার বেশি জাহাজ আমদানির ক্ষেত্রেই এই ভ্যাট ছাড় প্রযোজ্য হবে। সরকার মনে করছে, এর ফলে দেশে নৌপরিবহন খাতের আধুনিকীকরণ হবে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ বাড়বে এবং জাতীয় অর্থনীতিতে নতুন গতি আসবে।
এনবিআরের নির্দেশনায় আমদানিকারকদের যেসব শর্ত মানতে হবে সেগুলো হলো—
১. পতাকাবাহী নিবন্ধন ও আন্তর্জাতিক কনভেনশন মানা
আমদানি করা জাহাজকে অবশ্যই বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ হিসেবে নিবন্ধন করতে হবে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক সংস্থা (আইএমও) কর্তৃক গৃহীত ও বাংলাদেশ স্বাক্ষরিত আন্তর্জাতিক কনভেনশনগুলো কঠোরভাবে মানতে হবে। এর ফলে বাংলাদেশি জাহাজ আন্তর্জাতিক রুটে স্বীকৃতি ও গ্রহণযোগ্যতা পাবে।
২. জাহাজের বয়সসীমা
আমদানিকৃত জাহাজ ২৫ বছরের বেশি পুরোনো হতে পারবে না। এর মাধ্যমে আধুনিক, নিরাপদ ও কার্যকর জাহাজ ব্যবহারে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
৩. ব্যবহার ও বিক্রির নিয়ম
প্রতিটি আমদানি করা জাহাজ কমপক্ষে তিন বছর বাংলাদেশের পতাকাবাহী সমুদ্রগামী জাহাজ হিসেবে পণ্য পরিবহনে ব্যবহার করতে হবে। এই সময়ের মধ্যে তা বিক্রি বা হস্তান্তর করা যাবে না। তবে ব্যবসায়িক মন্দা, দুর্ঘটনা, দৈব-দুর্বিপাক বা স্ক্র্যাপ করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে এনবিআরকে ভ্যাট শোধ করার অঙ্গীকার দিতে হবে।
৪. বৈদেশিক আয়ের হিসাব ও জমা
জাহাজ থেকে প্রাপ্ত আয় এবং পরিচালন ব্যয় বাংলাদেশের কোনো তফসিলি ব্যাংকের ফরেন কারেন্সি (এফসি) হিসাবের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে হবে। এছাড়া প্রতি বছর সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্তৃক ইস্যুকৃত প্রসিড রিয়েলাইজেশন সার্টিফিকেট (পিআরসি) স্থানীয় ভ্যাট কার্যালয়ে জমা দিতে হবে। এটি মূলত বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে রাখা হয়েছে।
৫. অয়েল ট্যাংকারের নিরাপত্তা
অয়েল ট্যাংকার আমদানির ক্ষেত্রে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা থেকে সামুদ্রিক দূষণ রোধে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ও পরিবেশগত নিয়ম অনুসরণ করতে হবে। এ নিয়ম মানা না হলে পরিবেশগত ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।
৬. বাংলাদেশি নাবিকদের প্রাধান্য
জাহাজে কর্মরত জনবল বা নাবিকদের অন্তত ৭০ শতাংশ হতে হবে বাংলাদেশি নাগরিক। নিয়োগে বাংলাদেশিদের প্রাধান্য দিতে হবে। এতে দেশের নৌকর্মসংস্থান খাত সমৃদ্ধ হবে এবং দক্ষ নাবিক তৈরি হবে।
৭. অঙ্গীকারনামা ও আবেদন
সব শর্ত পালনের অঙ্গীকার করতে হবে ৩০০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে। একই সঙ্গে জাহাজের ধারণক্ষমতা, তৈরির দেশ ও সাল উল্লেখ করে এনবিআরে লিখিত আবেদন করতে হবে এবং তা গৃহীত হতে হবে।
বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের একটি বড় অংশ সমুদ্রপথে হয়ে থাকে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই দেশীয় পতাকাবাহী জাহাজের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। ফলে বিদেশি জাহাজের ওপর নির্ভরতা বাড়ছে, যার ফলে বৈদেশিক মুদ্রার বড় অঙ্ক দেশ থেকে বাইরে চলে যাচ্ছে। সরকার মনে করছে, এই ভ্যাট অব্যাহতি জাহাজ মালিকদের নতুন জাহাজ কেনায় উৎসাহিত করবে। নতুন জাহাজ এলে নৌপরিবহন খাতে সক্ষমতা বাড়বে, রপ্তানি পণ্যের পরিবহন খরচ কমবে এবং বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অবস্থান আরও শক্তিশালী হবে।
নৌপরিবহন খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভ্যাট ছাড় একদিকে ব্যবসায়ীদের খরচ কমাবে, অন্যদিকে দেশের পতাকাবাহী জাহাজের সংখ্যা বাড়াতে সহায়তা করবে। তবে শর্তগুলো কঠোর হওয়ায় এটি অপব্যবহার হওয়ার সুযোগ কম। বিশেষ করে জাহাজের বয়সসীমা ও বাংলাদেশি নাবিকদের প্রাধান্য শর্তগুলো দীর্ঘমেয়াদে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত ভ্যাট অব্যাহতির এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ব্যবসায়ীরা নতুন জাহাজ আমদানি করতে পারবেন। এরপর সরকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে সুযোগ বাড়াবে কিনা সে সিদ্ধান্ত নেবে। তবে সংশ্লিষ্ট মহল বলছে, এই সময়ের মধ্যে যদি যথেষ্টসংখ্যক আধুনিক জাহাজ বাংলাদেশি পতাকায় যুক্ত হয়, তাহলে দেশের নৌপরিবহন খাতে এক নতুন অধ্যায় সূচিত হবে।
বাংলাবার্তা/এসজে