
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের পোশাক শিল্প দীর্ঘদিন ধরেই বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান ধরে রেখেছে। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো বড় বাজারে দেশের পোশাক রপ্তানি স্থিতিশীল থাকলেও, এশিয়ার অন্যতম উন্নত অর্থনীতি জাপানে এখনো পুরো সম্ভাবনা কাজে লাগানো যায়নি। তবুও সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে, সেদিকে বড় ধরনের সুযোগ তৈরি হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিষয়ক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড সেন্টার (আইটিসি) প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বাংলাদেশ জাপানে ১.২৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে। যদিও এ অঙ্ক জাপানের মোট পোশাক আমদানির মাত্র ৫.৫০ শতাংশ, তবে এটিকে বিশেষজ্ঞরা নতুন প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্র হিসেবে দেখছেন।
একই সময়ে জাপান বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে মোট ২২.৮৫ বিলিয়ন ডলারের পোশাক আমদানি করেছে। এর মধ্যে নীট পোশাকের আমদানি হয়েছে ১১.৮৬ বিলিয়ন ডলার এবং ওভেন পোশাকের আমদানি হয়েছে ১০.৯৯ বিলিয়ন ডলার। নীট পোশাকের মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি ৬৩৩ মিলিয়ন ডলার (৫.৩৪ শতাংশ), আর ওভেন পোশাকের ক্ষেত্রে রপ্তানি হয়েছে ৬২৩ মিলিয়ন ডলার (৫.৬৮ শতাংশ)। এই দুটি খাত মিলেই জাপানের পোশাক আমদানিতে বাংলাদেশের মোট অবদান দাঁড়িয়েছে ১.২৬ বিলিয়ন ডলার।
বিজিএমইএ’র সাবেক পরিচালক মো. মহিউদ্দিন রুবেল এ তথ্যকে বাংলাদেশের জন্য বড় সুযোগের ইঙ্গিত হিসেবে দেখছেন। তিনি বলেন, “এই পরিসংখ্যান প্রমাণ করে যে জাপানে বাংলাদেশের রপ্তানির বিশাল সম্ভাবনা এখনও পুরোপুরি ব্যবহার হয়নি। জাপান একটি মান-সচেতন ও ফ্যাশনপ্রবণ বাজার, যেখানে উচ্চমূল্যের পণ্য বিক্রির সুযোগ অনেক বেশি।”
তার মতে, বাংলাদেশ এতদিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বাজারের ওপর অত্যধিক নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু ভবিষ্যৎ টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য জাপানের মতো অপ্রচলিত বাজারগুলোতে নজর দেওয়া জরুরি। তিনি আরও উল্লেখ করেন, “এসব বাজারে প্রবেশ শুধু রপ্তানির বৈচিত্র্যই নিশ্চিত করবে না, বরং বৈশ্বিক মন্দা বা রাজনৈতিক অস্থিরতার মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের শিল্পকে আরও স্থিতিশীল করে তুলবে।”
বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির প্রধান দুটি গন্তব্য হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। বর্তমানে দেশের মোট পোশাক রপ্তানির প্রায় ২০ শতাংশ যায় যুক্তরাষ্ট্রে, আর ৫০ শতাংশের মতো রপ্তানি হয় ইইউভুক্ত দেশগুলোতে। বাকি ৩০ শতাংশ রপ্তানি হয় বিভিন্ন অপ্রচলিত বাজারে, যার মধ্যে জাপান অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই বণ্টন প্রমাণ করে যে বাংলাদেশের রপ্তানি কাঠামো এখনো দুটি প্রধান বাজারের ওপরই বেশি নির্ভরশীল। এ কারণে কোনো সংকট দেখা দিলে রপ্তানিকারকরা ঝুঁকির মুখে পড়েন। জাপানের মতো উচ্চমানসম্পন্ন বাজারে অবস্থান শক্ত করা গেলে এ ঝুঁকি অনেকটা কমে যাবে।
অর্থনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, জাপানে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি এখনো সীমিত। তবে এটি যেমন চ্যালেঞ্জ, তেমনি বিশাল সুযোগও। চ্যালেঞ্জের দিক হলো—জাপানের বাজারে প্রতিযোগিতা অত্যন্ত কঠিন। চীন, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ভারতের মতো দেশগুলো সেখানে আগে থেকেই শক্ত অবস্থানে রয়েছে। তাদের তুলনায় বাংলাদেশকে আরও মানসম্পন্ন পণ্য, দ্রুত ডেলিভারি এবং প্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদন নিশ্চিত করতে হবে।
অন্যদিকে, সুযোগের দিক হলো—জাপানি ভোক্তারা সাধারণত মানসম্মত, টেকসই এবং নান্দনিক পোশাকের প্রতি বেশি আগ্রহী। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে কর্মীরা নকশা, ডিজাইন এবং উৎপাদন দক্ষতায় অনেকটা এগিয়ে এসেছে। সঠিক পরিকল্পনা নিলে জাপানের বাজারে বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব দ্রুত দ্বিগুণ বা তদূর্ধ্ব করা সম্ভব।
বাণিজ্য বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের উচিত এখন থেকেই জাপানের জন্য বিশেষ কৌশল নির্ধারণ করা। এর মধ্যে রয়েছে—
-
পরিবেশবান্ধব ও টেকসই উৎপাদন জোরদার করা
-
উচ্চমূল্যের ব্র্যান্ডেড পণ্য তৈরিতে মনোযোগ দেওয়া
-
জাপানি ক্রেতাদের জন্য বিশেষ মার্কেটিং কৌশল গ্রহণ
-
ব্যবসায়িক মেলা ও প্রদর্শনীতে সক্রিয় অংশগ্রহণ
-
দেশীয় উদ্যোক্তাদের ডিজাইন সক্ষমতা আরও বাড়ানো
এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা গেলে বাংলাদেশ শুধু জাপানে নয়, সমগ্র এশিয়ার উন্নত অর্থনীতিগুলোতে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান শক্ত করতে পারবে।
বর্তমানে জাপানে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি ১.২৬ বিলিয়ন ডলার হলেও এটি জাপানের বাজারের সামগ্রিক আকারের তুলনায় খুবই সামান্য। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, যদি সঠিক কৌশল ও বিনিয়োগ গ্রহণ করা যায় তবে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই এ বাজার থেকে দ্বিগুণ আয় সম্ভব। তাই জাপান এখন বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির জন্য এক ‘স্লিপিং জায়ান্ট’—যেখানে সম্ভাবনা অগাধ, কেবল দরকার সঠিক সময়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া।
বাংলাবার্তা/এমএইচ