
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর ও শুল্ক আদায় ব্যবস্থায় দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা দুর্নীতি, ঘুষ বাণিজ্য, স্বজনপ্রীতি এবং কর ফাঁকির সহযোগিতা—এসব অনিয়মের সঙ্গে জড়িত অভিযোগে এনবিআরের ছয় শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এই অনুসন্ধানের আওতায় আনা হয়েছে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সভাপতি ও অতিরিক্ত কমিশনার হাছান তারেক রিকাবদার এবং এনবিআর সদস্য (আয়কর নীতি) এ কে এম বদিউল আলমসহ মোট ছয়জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে।
রোববার (২৯ জুন) বিকেলে গণমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন দুদকের মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন।
তিনি জানান, “দুদক কারো হাতিয়ার হয়ে কাজ করে না। যাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে, তাদের বিষয়ে আগে থেকেই একাধিক লিখিত অভিযোগ, তথ্য-উপাত্ত এবং অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন আমাদের হাতে এসেছে। যাচাই-বাছাই করেই অনুসন্ধান শুরু হয়েছে।”
দুদকের অনুসন্ধানে যে ছয়জন কর্মকর্তার নাম উঠে এসেছে তারা হলেন- ১. এ কে এম বদিউল আলম (সদস্য, আয়কর নীতি, এনবিআর); ২. মির্জা আশিক রানা (অতিরিক্ত কর কমিশনার, সিনিয়র সহ সভাপতি, এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ); ৩. মোহাম্মদ মোরশেদ উদ্দীন খান (যুগ্ম কর কমিশনার, সদস্য, এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ); ৪. মোনালিসা শাহরীন সুস্মিতা (যুগ্ম কর কমিশনার, সহ সভাপতি, এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ); ৫. হাছান তারেক রিকাবদার (অতিরিক্ত কমিশনার, সভাপতি, এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ) ও ৬. সাধন কুমার কুন্ডু (অতিরিক্ত কমিশনার, সদস্য, এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ)।
দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধান বলছে, এই কর্মকর্তারা দীর্ঘদিন ধরেই কর ও শুল্ক আদায়ের ক্ষেত্রে করদাতাদের সঙ্গে আঁতাত করে মোটা অঙ্কের ঘুষ গ্রহণের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় রাজস্ব থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ফাঁকি দিতে সহযোগিতা করে আসছেন। বিশেষ করে আয়কর রিটার্ন যাচাই-বাছাইয়ের ক্ষেত্রে এসব কর্মকর্তা করদাতাদের কর কমিয়ে দিয়ে নিজেরা লাভবান হয়েছেন। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন রাষ্ট্রের রাজস্ব আয় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তেমনি কর কাঠামোর ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা হারিয়েছে।
একাধিক অভিযোগের ভিত্তিতে দুদক জানিয়েছে, এসব কর্মকর্তা প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার অবৈধ লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত। করদাতা কোনো প্রতিষ্ঠান আগাম কর দিলেও, পরে কর হিসাব অনুযায়ী সেই করের বাড়তি অংশ ফেরত পাওয়ার ক্ষেত্রে করদাতাকে ফের এক দফা ঘুষ দিতে হয়। ঘুষের পরিমাণ কখনো কখনো ওই ফেরতযোগ্য টাকার ৫০ ভাগ পর্যন্ত পৌঁছায়।
এমনকি অভিযোগ রয়েছে, কেউ যদি ঘুষ না দেন, তাহলে তাদের নামে মিথ্যা কর ফাঁকির মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়। ফলে করদাতারা নিরুপায় হয়ে ঘুষ দিতে বাধ্য হন। এভাবে একদিকে সরকার বিপুল অঙ্কের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে সাধারণ ব্যবসায়ী ও করদাতারা চরম হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
দুদকের কাছে জমা হওয়া একাধিক প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, গত দুই যুগে অর্থাৎ প্রায় ২০-২৫ বছরের কর্মজীবনে এই কর্মকর্তারা দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনে দায়িত্ব পালন করেন এবং বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তি ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গোপন আঁতাত করে শুল্ক, ভ্যাট ও কর ফাঁকির নানা সুবিধা দিয়েছেন। বিনিময়ে তারা নিজেরাও হয়েছেন বিপুলভাবে লাভবান।
তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সরকারি কর্মচারী হয়েও তারা বিলাসবহুল জীবনযাপন করছেন, যা তাদের ঘোষিত আয় ও সম্পদের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। অনেকেই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ফ্ল্যাট, জমি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এবং ব্যাংক একাউন্টে অস্বাভাবিক পরিমাণ টাকা ও সম্পদ অর্জন করেছেন বলে অনুসন্ধান প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
এই অনুসন্ধান সামনে আসার সময়টিও বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, সম্প্রতি এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ ‘চেয়ারম্যানের পদত্যাগ’-এর দাবিতে আন্দোলনে নেমেছে এবং রাজস্ব সংগ্রহ কার্যক্রম পুরোপুরি স্থবির করে দিয়েছে। এনবিআর কর্মীদের ধর্মঘট ও শাটডাউন কর্মসূচির মধ্যে হঠাৎ এই অনুসন্ধানের ঘোষণাকে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
তবে দুদক বলছে, এটি পূর্বপরিকল্পিত অনুসন্ধান এবং কোনো পক্ষের চাপে নয়, বরং দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থার নিয়মতান্ত্রিক পদক্ষেপ। দুদক মহাপরিচালক বলেন, “দুর্নীতি যেখানেই হোক, যেই করুক, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। এনবিআরের এই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
রাজস্ব আদায়ের এই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে এই দুর্নীতির অনুসন্ধান রাজস্ব খাতে দীর্ঘদিনের অনিয়ম, অস্বচ্ছতা এবং স্বার্থসংশ্লিষ্ট চক্রের দৌরাত্ম্যের একটি বড় উদাহরণ। এই অনুসন্ধান কতদূর যাবে এবং সত্যিকার অপরাধীদের মুখোশ উন্মোচন হবে কি না, তা এখন পুরো জাতির দৃষ্টির কেন্দ্রে।
দুদকের এই অনুসন্ধান শুধু এনবিআরের ৬ কর্মকর্তার নয়—বরং গোটা রাজস্ব ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা ও ন্যায়পরায়ণতা পুনরুদ্ধারের এক সম্ভাব্য সূচনা।
বাংলাবার্তা/এসজে