
ছবি: সংগৃহীত
চার বছর আগে মুন্সীগঞ্জ শহরের উত্তর ইসলামপুর এলাকায় ইভটিজিংয়ের ঘটনাকে কেন্দ্র করে আয়োজিত এক সালিশি বৈঠকে ঘটে যায় এক রক্তাক্ত ট্র্যাজেডি—যেখানে একই রাতে ছুরিকাঘাতে প্রাণ হারান তিনজন। সেই বহুল আলোচিত মামলার রায় ঘোষণা করল ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৩। বৃহস্পতিবার (৮ মে) ট্রাইব্যুনালের বিচারক মাসুদ করিম আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তিন আসামিকে মৃত্যুদণ্ড এবং পাঁচজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করেন। পাশাপাশি আদালত অপর ১০ জনকে অভিযোগ প্রমাণ না হওয়ায় খালাস দেন।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত তিন আসামি হলেন—সৌরভ প্রধান, রনি বেপারী ও শিহাব প্রধান। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ আসামি হলেন—শাকিব প্রধান, শামীম প্রধান, অনিক বেপারী, রায়হান এবং ছোট জাহাঙ্গীর।
এদের মধ্যে শিহাব, শাকিব এবং শামীম আপন ভাই, যা আদালতে জানান মামলার রাষ্ট্রপক্ষের স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর মো. বিল্লাল হোসেন। বাকি ১০ জন অভিযুক্তকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে প্রমাণের অভাবে।
মামলার তদন্ত ও চার্জশিট অনুযায়ী, ২০২১ সালের ২৪ মার্চ বিকেলে মুন্সীগঞ্জ শহরের উত্তর ইসলামপুর এলাকায় দুই দল কিশোর ও তরুণদের মধ্যে মারামারির ঘটনা ঘটে। জানা যায়, একটি ইভটিজিংয়ের অভিযোগকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। বিষয়টি মীমাংসার জন্য সেদিন রাতেই স্থানীয়ভাবে সালিশ ডাকেন এলাকার কয়েকজন। কিন্তু সালিশে বিরোধের অবসান তো হয়নি বরং সংঘর্ষে রূপ নেয় বৈঠক।
সালিশ চলাকালীন সময়ে এক পর্যায়ে সৌরভ, শিহাব ও শামীমসহ কয়েকজন হঠাৎ ছুরি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা মো. ইমন হোসেন (২২), মো. সাকিব হোসেন (১৯) এবং মিন্টু প্রধান (৪০)–এই তিনজনকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে। নিহতদের মধ্যে মিন্টু ছিলেন এলাকার একজন সম্মানিত ব্যক্তি এবং সালিশের আহ্বায়ক দলের একজন। বাকি দু’জন ছিলেন তার আত্মীয় ও প্রতিবেশী।
এ ঘটনার পর ২৬ মার্চ নিহত মিন্টুর স্ত্রী খালেদা আক্তার বাদী হয়ে মুন্সীগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় নাম উল্লেখ করে ১২ জনকে এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরও ১০-১৫ জনকে আসামি করা হয়। পরে তদন্ত শেষে পুলিশের দেওয়া চার্জশিটে মূল অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা হয়।
চার বছর ধরে চলা বিচার প্রক্রিয়া শেষে অবশেষে আজ রায় ঘোষণা হলেও এতে সন্তুষ্ট হতে পারেননি রাষ্ট্রপক্ষ ও নিহত মিন্টু প্রধানের স্ত্রী খালেদা আক্তার। আদালতের রায় শুনেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। গণমাধ্যমের সামনে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, "আমি ন্যায়বিচার পাইনি। যেভাবে আমার স্বামীকে প্রকাশ্যে খুন করা হয়েছে, সেই অনুযায়ী সব অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া হয়নি। অনেক খুনি খালাস পেয়ে গেছে। যতদিন বেঁচে আছি, ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই করে যাব। প্রয়োজনে উচ্চ আদালতে যাব।"
রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি বিল্লাল হোসেনও খালেদা আক্তারের বক্তব্যের সঙ্গে একমত প্রকাশ করে জানান, এই রায়ে তারা সন্তুষ্ট নন এবং উচ্চ আদালতে আপিল করা হবে।
এই মামলার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো—মামলার শুরুতে অভিযুক্তদের তালিকায় মোট ১২ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছিল এবং আরও ১০-১৫ জন অজ্ঞাত ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। অথচ চার বছর পর রায়ে কেবল ৮ জনকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে এবং ১০ জন খালাস পেয়েছে। অর্থাৎ যেসব অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের নাম প্রাথমিকভাবে এজাহারে উল্লেখ ছিল, তাদের সনাক্ত ও বিচার হয়নি। নিহত পরিবারগুলোর মতে, ঘটনার দিন হামলায় আরও অনেকে অংশ নিয়েছিল, যাদের কেউ আইনের আওতায় আসেনি।
স্থানীয়দের মতে, এই হত্যাকাণ্ড পুরো মুন্সীগঞ্জ জেলাব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। নিরাপত্তাহীনতা, বিচারহীনতা ও স্থানীয় রাজনীতির প্রভাব এই ঘটনাকে আরও জটিল করে তোলে। রায় ঘোষণার পর এলাকায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। কেউ কেউ বলছেন, কমপক্ষে কিছু আসামির বিচার হয়েছে, এটি ইতিবাচক; আবার অনেকে মনে করছেন, সব অপরাধীর শাস্তি না হওয়ায় এটি ন্যায়বিচারের অপূর্ণতা।
মুন্সীগঞ্জের উত্তর ইসলামপুরের তিন প্রাণের হত্যাকাণ্ডের চার বছর পর বিচারিক রায় এলেও তা যেন অনেক প্রশ্ন রেখে গেলো। যাদের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন ইমন, সাকিব ও মিন্টু প্রধান, তাদের সবাই কি শাস্তি পেয়েছে? নাকি কেউ কেউ রাজনৈতিক বা সামাজিক প্রভাবের কারণে রক্ষা পেয়ে গেছে?
যা-ই হোক, নিহতদের পরিবার বলছে, তাদের লড়াই এখানেই শেষ নয়। উচ্চ আদালতের দরজায় তারা আবারও কড়া নাড়বে—ন্যায়বিচারের আশায়।
এই মামলা বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় আরেকটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে—যেখানে একটি ট্রিপল মার্ডার মামলায় আদালতের রায় এবং ভুক্তভোগীদের প্রতিক্রিয়া এক গভীর সামাজিক বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ