
ছবি: সংগৃহীত
সিলেটের এক যুগান্তকারী মামলায় দীর্ঘ প্রায় ১৪ বছর পর বেরিয়ে এল এক মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের বিচারিক রায়। নামাজরত অবস্থায় নিজের বাবাকে নির্মমভাবে হত্যার দায়ে ছেলেসহ তিনজনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন সিলেট বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালত। মঙ্গলবার (৬ মে) সকালে এই রায় ঘোষণা করেন বিচারক মো. শাহাদত হোসেন প্রামাণিক।
দণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন: নিহত প্রবীণ আইনজীবী শামসুল ইসলাম চৌধুরীর ছোট ছেলে মাসুদ আহমদ চৌধুরী মুন্না, তার দুই সহযোগী জাহের আলী ও আনসার আহমদ। এছাড়া এই হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত গাড়িচালক বোরহান উদ্দিনকে তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তবে আদালতের দেওয়া রায়ের সময় চার আসামিই পলাতক ছিলেন।
ঘটনাটি ঘটেছিল শবেবরাতের রাতে, নামাজরত বাবার ওপর ছেলের হামলা
মামলার সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) অ্যাডভোকেট মো. আনছারুজ্জামান জানান, ২০১১ সালের ১৭ জুলাই রাতে শবেবরাত উপলক্ষে প্রবীণ আইনজীবী অ্যাডভোকেট শামসুল ইসলাম চৌধুরী তার নিজ বাসায় ইবাদতে রত ছিলেন। এ সময় তার নিজেরই ছোট ছেলে মাসুদ আহমদ চৌধুরী মুন্না পরিকল্পিতভাবে পেছন থেকে পাথর দিয়ে মাথায় আঘাত করেন। এতে গুরুতর জখম হয়ে শামসুল ইসলাম জ্ঞান হারান।
পরবর্তী সময়ে মাসুদ ও তার সহযোগীরা ভিকটিমকে চেতনানাশক ইনজেকশন দিয়ে অচেতন করে সিলেট থেকে একটি গাড়িতে তুলে নিয়ে যান সুনামগঞ্জের ছাতকের মল্লিকপুর এলাকায়। সেখান থেকে তাকে ফেলে দেওয়া হয় সুরমা নদীর গভীর জলে। এ ঘটনায় মুন্নার সঙ্গে জাহের আলী, আনসার আহমদ এবং গাড়িচালক বোরহান উদ্দিন সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়।
কয়েকদিন পর উদ্ধার হয় মরদেহ, শুরু হয় তদন্ত
এই ঘটনার কয়েকদিন পর সুনামগঞ্জ জেলার ব্রাহ্মণগাঁও গ্রামের পাশে সুরমা নদীতে ভেসে ওঠে প্রবীণ আইনজীবী শামসুল ইসলাম চৌধুরীর নিথর দেহ। তার পরিবারের সদস্যদের পক্ষ থেকে এ ঘটনায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। মামলার বাদী ছিলেন নিহতের বড় ছেলে মাহমুদ আহমদ চৌধুরী।
দীর্ঘ তদন্ত শেষে চারজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় তদন্তকারী সংস্থা। মামলার বিচার চলাকালে আদালত মোট ৩০ জন সাক্ষীর মধ্যে ১৯ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন।
আদালতের পর্যবেক্ষণ: বাবার হত্যায় ছেলের অংশগ্রহণ ‘নৃশংসতার চূড়ান্ত উদাহরণ’
রায় ঘোষণার সময় বিচারক মো. শাহাদত হোসেন প্রামাণিক বলেন, “পৃথিবীতে বাবা-ছেলের সম্পর্ক সবচেয়ে মধুর ও আত্মিক। বৃদ্ধ বয়সে একজন বাবা তার ছেলের ওপর নির্ভর করেন। এমন এক পবিত্র সম্পর্কের প্রতি চরম অবজ্ঞা ও নৃশংসতা প্রদর্শন করেছে আসামি মাসুদ ও তার সহযোগীরা।”
তিনি আরও বলেন, “এটি শুধুমাত্র জমি সংক্রান্ত বিরোধে ঘটে যাওয়া একটি নির্মম হত্যাকাণ্ড নয়, বরং এটি মানবতা ও পারিবারিক মূল্যবোধের ওপর সরাসরি আঘাত। সমাজে এমন ঘটনা বিরল হলেও ন্যায়বিচারের স্বার্থে এবং ভবিষ্যতের জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে এমন রায় প্রয়োজন।”
পরিবারে শোক ও বিভক্তি
নিহত অ্যাডভোকেট শামসুল ইসলাম চৌধুরীর পরিবারে রয়েছে চার মেয়ে ও দুই ছেলে। তার বড় ছেলে মাহমুদ আহমদ চৌধুরী ছিলেন মামলার বাদী পক্ষের অন্যতম ব্যক্তি। আদালতে তার পক্ষে আইনজীবী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন অ্যাডভোকেট গোলাম এহিয়া চৌধুরী সোহেল।
পিপি বদরুল ইসলাম চৌধুরী জানান, এই মামলার রায়ের মাধ্যমে নিহতের পরিবারের দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হলো। “অবশ্যই এটি একটি দৃষ্টান্তমূলক রায়, যেখানে আত্মীয়তার সম্পর্কের আড়ালে লুকিয়ে থাকা অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করা হয়েছে।”
পলাতক আসামিদের দ্রুত গ্রেফতারের আহ্বান
রায় ঘোষণার পর মামলার বাদী পক্ষ ও রাষ্ট্রপক্ষ উভয়ই সন্তোষ প্রকাশ করেন। তবে তারা জানিয়েছেন, রায় কার্যকরে আসামিদের দ্রুত গ্রেফতার করা জরুরি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
এ ঘটনাটি শুধু একটি পারিবারিক হত্যাকাণ্ড নয়—এটি একটি ভয়াবহ সামাজিক সংকেতও। যেখানে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করে ব্যক্তি স্বার্থে মানুষ কতটা নিচে নামতে পারে, তারই একটি করুণ দৃষ্টান্ত এটি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ