
ছবি: সংগৃহীত
বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন আর মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত প্রতীক বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী তাঁর সহধর্মিণী ও দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহযাত্রী নাসরিন সিদ্দিকীকে নিজ গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করেছেন। স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসেবে কাদের সিদ্দিকী তাঁকে তাঁর বাবা-মায়ের পাশেই চিরনিদ্রায় শায়িত করলেন। শনিবার রাতে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন নাসরিন সিদ্দিকী। তাঁর মৃত্যুসংবাদ ছড়িয়ে পড়লে দলীয় নেতাকর্মী, শুভানুধ্যায়ী, স্বজন ও বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতাদের মাঝে শোকের ছায়া নেমে আসে।
রোববার দুপুরে টাঙ্গাইল শহরের ঐতিহাসিক পিটিআই মাঠে প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ (কৃষকশ্রমিক জনতা লীগ) ছাড়াও বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা, বীর মুক্তিযোদ্ধারা এবং বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ অংশ নেন। জানাজা শেষে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় তাঁর স্বামী কাদের সিদ্দিকীর জন্মস্থান টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার ছাতিহাটি গ্রামে।
সেখানেই গ্রামের বাড়ির উঠানে, নাগবাড়ী ইউনিয়নের ছাতিহাটিতে বাদ আসর দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় আবারও বহু মানুষ অংশ নেন—স্বজন, প্রতিবেশী, অনুসারী, রাজনৈতিক নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষ। সব বয়সী মানুষ দাঁড়িয়ে ছিলেন শ্রদ্ধার আবেগে নীরব, অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
দ্বিতীয় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে কাদের সিদ্দিকীর বাবা-মায়ের কবরের পাশে কবরস্থ করা হয় নাসরিন সিদ্দিকীকে। যে স্থানে কাদের সিদ্দিকীর শৈশব কেটেছে, সেই মাটিতেই স্ত্রীকে শেষ বিদায় জানিয়ে তিনি বারবার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে চোখের পানি মুছছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি কবরের পাশে বসে পড়েন, পাশে থাকা ভাই লতিফ সিদ্দিকী ও মুরাদ সিদ্দিকী তাঁকে সান্ত্বনা দেন।
কাদের সিদ্দিকীর পরিবার ছাড়াও জানাজায় উপস্থিত ছিলেন টাঙ্গাইল জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ ইকবাল, জেলা জামায়াতের আমির আহসান হাবীব মাসুদ, কাদের সিদ্দিকীর ভাই সাবেক মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী, মুরাদ সিদ্দিকী, আজাদ সিদ্দিকী, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দ, বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধারা ও নানা শ্রেণিপেশার মানুষ।
নাসরিন সিদ্দিকী দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। তিনি ছিলেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। শুধু রাজনৈতিক পদ-পদবিতেই নয়, বাস্তবে তিনি কাদের সিদ্দিকীর রাজনৈতিক সংগ্রামের সহযোদ্ধা ছিলেন। দলীয় কার্যক্রম, সাংগঠনিক বিভিন্ন সিদ্ধান্ত এবং রাজনৈতিক সংকটময় মুহূর্তে স্ত্রী হিসেবে নয়, একজন রাজনৈতিক সহযোগী হিসেবেও তিনি পাশে ছিলেন। একাধিক নেতাকর্মী বলেন, “নাসরিন আপা ছিলেন আমাদের সবার বড় বোনের মতো। তিনি শুধু নেতার স্ত্রী ছিলেন না, ছিলেন রাজনীতির প্রাণ।”
বেশ কিছুদিন ধরেই শারীরিকভাবে অসুস্থ ছিলেন তিনি। সম্প্রতি হঠাৎ করে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত জটিলতায় রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শনিবার রাতে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তিনি স্বামী, সন্তান, আত্মীয়স্বজন ও অসংখ্য রাজনৈতিক সহযোদ্ধাকে রেখে গেছেন।
নাসরিন সিদ্দিকী কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের কার্যক্রমে সবসময় সক্রিয় থেকেছেন। স্বামীর মতোই তিনি ছিলেন একজন আপসহীন দেশপ্রেমিক। কখনও সামনে থেকে, কখনও পেছন থেকে কাদের সিদ্দিকীর রাজনীতিকে শক্ত ভিত্তি দিয়েছেন। দলের একাধিক নেতার মতে, নাসরিন সিদ্দিকীর নীরব রাজনৈতিক অবদান ছিল অসামান্য, যা হয়তো কখনো পত্রিকার শিরোনাম হয়নি, কিন্তু দলীয় সংগঠনে তিনি ছিলেন সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য অবলম্বন।
নাসরিন সিদ্দিকীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা, সামাজিক সংগঠন ও বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়, “আমরা হারিয়েছি আমাদের এক বাতিঘরকে। যিনি সংগঠনকে হৃদয়ের জায়গা থেকে আগলে রেখেছেন, সেই মানুষটিকে হারিয়ে আমরা আজ গভীরভাবে শোকাহত।”
একই সঙ্গে কাদের সিদ্দিকীর প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করে অনেকেই বলেন, “তিনি যেমন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, তেমনি একজন স্নেহপরায়ণ স্বামী। আজ তাঁর জীবনের সবচেয়ে বিশ্বস্ত সঙ্গীকে হারিয়ে তিনি যেন একা হয়ে গেছেন।”
বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনেক সময়ই স্ত্রীর ভূমিকা থেকে যায় অন্তরালে, কিন্তু নাসরিন সিদ্দিকী ছিলেন এক ব্যতিক্রম। তিনি ছিলেন রাজনৈতিক সহযাত্রী, পারিবারিক প্রেরণার উৎস এবং ত্যাগের প্রতীক। তাঁর মৃত্যুতে যে শূন্যতা তৈরি হলো, তা কেবল কাদের সিদ্দিকীর ব্যক্তিগত জীবনে নয়, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের রাজনীতিতেও গভীর প্রভাব ফেলবে। বাবা-মায়ের কবরের পাশে স্ত্রীর দাফন কাদের সিদ্দিকীর জীবনের এক অন্তহীন শোকের প্রতীক হয়ে থাকবে, যেখানে ভালোবাসা, বন্ধন ও দেশপ্রেম এক অনন্ত স্মৃতিতে রূপ নিল।
বাংলাবার্তা/এমএইচ