
ছবি: সংগৃহীত
শরীয়তপুর জেলায় নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা ক্রমেই উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। গত আট মাসে জেলায় মোট ২৬টি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে, যা জনমনে ব্যাপক আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। বিভিন্ন কারণে এই হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটলেও মূলত জমিজমা বিরোধ, আধিপত্য বিস্তার, পারিবারিক কলহ, আর্থিক লেনদেনের জটিলতা ও ডাকাতি সন্দেহজনক ঘটনায় এসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে পুলিশ ও স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
কোথায় কত হত্যাকাণ্ড
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শরীয়তপুর সদর উপজেলায় ৫টি, নড়িয়ায় ৩টি, জাজিরায় ৫টি, ভেদরগঞ্জে ৪টি, গোসাইরহাটে ৫টি এবং সখিপুর থানায় ৪টি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। অর্থাৎ জেলার ছয়টি থানার প্রতিটিতেই নিয়মিতভাবে হত্যাকাণ্ড ঘটছে। পুলিশের তথ্য বলছে, গড়ে মাসে তিনটিরও বেশি খুনের ঘটনা ঘটছে শরীয়তপুরে, যা স্থানীয়দের জন্য বড় ধরনের নিরাপত্তা সংকট তৈরি করেছে।
হত্যার পেছনের কারণ
পুলিশি তদন্ত ও গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে জানা যায়, গত আট মাসের হত্যাকাণ্ডগুলোর মধ্যে জমিজমা বিরোধ থেকে ৩টি, টাকা-পয়সা লেনদেনের কারণে ৩টি, পারিবারিক কলহ থেকে ৭টি, ডাকাতি সন্দেহে ৪টি এবং অজ্ঞাত লাশ উদ্ধারের ঘটনা ৪টি। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধরনের কারণগুলো বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে বহুকাল ধরেই বিরাজমান থাকলেও এখন এগুলো ক্রমেই ভয়াবহ আকার ধারণ করছে।
আতঙ্কে স্থানীয় জনতা
শিক্ষার্থী, সাধারণ মানুষ ও সচেতন মহলের দাবি, এলাকায় এখন নিরাপত্তাহীনতা চরম আকার ধারণ করেছে। শহরমুখী শিক্ষার্থীরা সর্বক্ষণ আতঙ্কে থাকে—কোথায়, কখন কী ঘটতে পারে সেই আশঙ্কায় তারা স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারছে না। তাদের ভাষায়, সামাজিক মূল্যবোধের অভাব ও প্রভাবশালী গোষ্ঠীর আধিপত্য বিস্তারের কারণে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটছে।
বিশেষজ্ঞ ও সমাজ বিশ্লেষকদের মতামত
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, আইনের প্রতি আস্থার অভাব মানুষের মধ্যে এক ধরনের হিংস্রতা তৈরি করেছে। মানুষ ছোটখাটো দ্বন্দ্বে আইনকে পাশ কাটিয়ে নিজের হাতে শাস্তি দিতে চাইছে, যা সমাজকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলছে। বিশেষ করে কিশোরদের মধ্যে বড়দের অপরাধের প্রতিফলন ঘটছে। কিশোর গ্যাং তৈরি হচ্ছে, তারা অস্ত্র ব্যবহার করছে এবং পরিণামে সমাজের জন্য ভয়াবহ হুমকি হয়ে উঠছে।
আদালতের বক্তব্য
শরীয়তপুর জেলা দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট মনিরুজ্জামান দিপু বলেন, “একটি হত্যাকাণ্ড শুধু ভুক্তভোগী পরিবারকে নয়, অপরাধীর পরিবারকেও নিঃস্ব করে দেয়। তাই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে, আইন নিজের হাতে নেয়া যাবে না। শিশু-কিশোরদের মধ্যে বড়দের অপরাধের প্রতিচ্ছবি দেখা গেলে তা সমাজে আরও অপরাধ বাড়িয়ে তোলে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য পুলিশ প্রশাসনকে সহযোগিতা করতে হবে।”
পুলিশের অবস্থান
শরীয়তপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) মো. নজরুল ইসলাম জানান, জেলার প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত অব্যাহত আছে। “২৬টি হত্যাকাণ্ডের মধ্যে চারটিতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে, দুইটিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে এবং বাকি ২০টি মামলা তদন্তাধীন রয়েছে। আমরা স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করছি এবং অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।” তিনি আরও বলেন, “যেকোনো ঘটনায় মানুষ যেন আইন নিজের হাতে না নেয়, আগে পুলিশকে জানায়। জনগণের সহযোগিতা ছাড়া কোনো অপরাধ দমন সম্ভব নয়।”
সামাজিক সংকট ও করণীয়
শরীয়তপুরে একের পর এক হত্যাকাণ্ড শুধু আইনশৃঙ্খলার প্রশ্ন নয়, বরং সামাজিক সংকটেরও প্রতিফলন। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নৈতিক শিক্ষা, পারিবারিক বন্ধন ও সামাজিক ঐক্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা না গেলে এ ধারা বন্ধ হবে না। আধিপত্য বিস্তার, রাজনৈতিক প্রভাব ও ক্ষমতার দাপটের সঙ্গে যদি প্রশাসনিক শৈথিল্য মিলে যায়, তবে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা আরও কঠিন হয়ে পড়বে।
শরীয়তপুরে গত আট মাসে ২৬টি হত্যাকাণ্ড সাধারণ মানুষের মধ্যে গভীর শঙ্কা তৈরি করেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চেষ্টা চালালেও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, পারিবারিক বিরোধ, অর্থনৈতিক জটিলতা এবং আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতা এ হত্যার মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনমতের দাবি, পুলিশকে আরও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে এবং জনগণকে আইনের প্রতি আস্থা রেখে সহযোগিতা করতে হবে। অন্যথায় এই ধারা থামানো কঠিন হবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ