
ছবি: সংগৃহীত
কখনো কখনো জয় কেবল একটা জয় নয়—তা হয়ে ওঠে আত্মবিশ্বাসের ভিত্তি, ভবিষ্যতের জন্য অনুপ্রেরণা। আজ তেমন এক জয় তুলে নিল বাংলাদেশ। ঢাকায় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টিতে এক রুদ্ধশ্বাস লড়াইয়ের পর পাকিস্তানকে মাত্র ৮ রানে হারিয়ে এক ম্যাচ হাতে রেখেই সিরিজ নিশ্চিত করল লিটন দাসের দল।
ছোট লক্ষ্য, অস্থির উইকেট, দুই দলের ভঙ্গুর ব্যাটিং লাইনআপ আর দুর্দান্ত বোলিং—সবকিছুর মিশেলে এই ম্যাচটি হয়ে উঠেছিল উত্তেজনার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। একদিকে বাংলাদেশের বোলারদের নিয়ন্ত্রিত আগ্রাসন, অন্যদিকে ফাহিম আশরাফ ও আহমাদ দানিয়ালের দুঃসাহসী লড়াই—এই দুইয়ের দ্বন্দ্বে শেষ হাসি হাসল স্বাগতিকরাই।
সকাল থেকেই ঢাকার উইকেটে ঘাস এবং স্যাঁতসেঁতে ভাব নিয়ে আলোচনা চলছিল। টস জিতে প্রথমে ফিল্ডিং নেওয়া পাকিস্তানের সিদ্ধান্ত যে সঠিক ছিল, তা ইনিংসের শুরুতেই বোঝা যায়।
ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারেই প্রথম ধাক্কা খায় বাংলাদেশ। ওপেনার নাঈম শেখ ফিরেন মাত্র ৩ রানে। এরপর একে একে সাজঘরে ফেরেন লিটন দাস, তৌহিদ হৃদয় ও পারভেজ হোসেন ইমন। পাওয়ার প্লে শেষে স্কোরবোর্ডে ছিল মাত্র ২৯ রান, ততক্ষণে ৪ উইকেট হারিয়ে ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়ে দল।
দলকে টেনে তোলার চেষ্টায় হাত বাড়ান জাকের আলী ও মেহেদী হাসান। এই জুটি গড়ে তোলে ৫৩ রানের গুরুত্বপূর্ণ পার্টনারশিপ, যা পাকিস্তানের বিপক্ষে এই উইকেটে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ। মেহেদী হাসান ছিলেন তুলনামূলক আক্রমণাত্মক। তিনি ২৫ বলে ৩৩ রান করেন, একটি ছক্কা মারার পরের বলেই আউট হন।
মেহেদীর বিদায়ের পর বাংলাদেশের ইনিংস আবারও নড়বড়ে হয়ে পড়ে। একে একে ফিরে যান শামীম হোসেন, তানজিম হাসান, রিশাদ হোসেন। তবে একপ্রান্ত আগলে রাখেন জাকের আলী। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে খেলে যান তিনি। শেষ ওভারে পাকিস্তানের ডেথ ওভার স্পেশালিস্ট আব্বাস আফ্রিদির এক ওভারে দুটি ছক্কা হাঁকিয়ে দলকে সম্মানজনক স্কোরে নিয়ে যান। নিজের ফিফটি পূর্ণ করেন ছক্কা মেরে, তবে ইনিংসের শেষ বলে আরেকটি বড় শট খেলার চেষ্টায় বাউন্ডারিতে ক্যাচ দিয়ে আউট হন ৫৫ রান করে।
বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত অলআউট হয় ১৯.৫ ওভারে ১৩৩ রান করে। দলের স্কোরবোর্ডে আলো জ্বালান কেবল জাকের আলী ও মেহেদী হাসান। বাকিদের ব্যাটে ছিল শুধুই ধস।
ছোট লক্ষ্য তাড়া করতে নামা পাকিস্তানের জন্য ম্যাচটা খুব সহজ হবার কথা ছিল না। কিন্তু স্বপ্নেও কেউ ভাবেনি, মাত্র ১৫ রানে ৫ উইকেট হারাবে তারা! ইনিংসের প্রথম বলেই রানআউট হন সাইম আইয়ুব। এরপর একে একে ফিরতে থাকেন মোহাম্মদ হারিস, ফখর জামান, হাসান নেওয়াজ ও মোহাম্মদ নেওয়াজ।
তানজিম হাসান সাকিব এবং শরীফুল ইসলাম—দুই পেসার যেন আগুন ঝরালেন প্রথম ৫ ওভারে। তাদের দুর্দান্ত লাইন ও লেংথ, নিখুঁত ইয়র্কার এবং শর্ট বলের সংমিশ্রণে বিপর্যস্ত হয় পাকিস্তান। পাঁচ টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানকে হারিয়ে মাত্র ১৫ রানেই ভেঙে পড়ে সফরকারীদের ব্যাটিং স্তম্ভ।
পাকিস্তান এরপরও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। আগা সালমান ও খুশদিল শাহের কাছ থেকে বড় ইনিংসের প্রত্যাশা থাকলেও তারা খুব বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি। খুশদিল একটি জীবন পেয়েও তা কাজে লাগাতে ব্যর্থ হন। মেহেদী হাসানের কৌশলী বোলিংয়ে এলবিডব্লু হয়ে সাজঘরে ফেরেন তিনি। ৪৭ রানে ৭ উইকেট হারিয়ে পাকিস্তান তখন ম্যাচ হেরে বসেছে, এমনটাই মনে হচ্ছিল।
কিন্তু ক্রিকেট অনিশ্চয়তার খেলা। আর সেই অনিশ্চয়তা এনে দেন ফাহিম আশরাফ। একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থেকে ম্যাচে ফিরিয়ে আনার মরিয়া চেষ্টা চালান তিনি। বিশেষ করে রিশাদ হোসেনের এক ওভারে ২০ রান নিয়ে পাকিস্তান শিবিরে নতুন আশার আলো জ্বালান এই অলরাউন্ডার।
১৭তম ওভারে শরীফুল ফিরিয়ে দেন আব্বাস আফ্রিদিকে। তবে তানজিম হাসানের এক ক্যাচ ফেলে দেওয়ায় বেঁচে যান ফাহিম। তখন থেকেই শুরু হয় উত্তেজনা।
১৯তম ওভারে রিশাদ হোসেনের বিপক্ষে ফাহিম-দানিয়াল জুটি তুলে নেয় ১৫ রান। শেষ বলে রিশাদ যখন ফাহিমকে বোল্ড করেন, তখন বাংলাদেশের জয়ের আশা আবার জেগে ওঠে। কিন্তু পাকিস্তানের হাতে তখনো এক উইকেট বাকি, দরকার মাত্র ১৩ রান।
২০তম ওভারে বল তুলে দেওয়া হয় অভিজ্ঞ মোস্তাফিজুর রহমানের হাতে। প্রতিপক্ষের হাতে এক উইকেট, বাংলাদেশের দরকার একটি বলেই জয়। প্রথম বলেই চার মারেন আহমাদ দানিয়াল—ম্যাচ আবারও হাতছাড়া হওয়ার শঙ্কা। কিন্তু পরের বলেই দানিয়াল ছক্কা মারতে গিয়ে বাউন্ডারিতে ক্যাচ দিয়ে ফিরে যান।
১২৫ রানেই থেমে যায় পাকিস্তানের ইনিংস, ৮ রানের নাটকীয় জয় পায় বাংলাদেশ। ফাহিম আশরাফ করেন ৪৫ রান, কিন্তু জয়ের জন্য তা যথেষ্ট ছিল না। পুরো ম্যাচজুড়ে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে সমানে লড়ে শেষ পর্যন্ত উল্লাসে ফেটে পড়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা।
এই জয়ের মধ্য দিয়ে দুই ম্যাচে ২-০ ব্যবধানে সিরিজ নিজেদের করে নিল বাংলাদেশ। তৃতীয় ও শেষ ম্যাচটি এখন কেবল আনুষ্ঠানিকতা, তবে সেটাও হতে পারে তরুণদের আত্মবিশ্বাস মজবুত করার সুযোগ।
অধিনায়ক লিটন দাসের নেতৃত্বে এই জয় শুধু একটি সিরিজ জেতা নয়, বরং ব্যাটিংয়ের দুর্বলতা সত্ত্বেও বোলিং আর মনোবলের শক্তিতে কীভাবে জেতা যায়—তার অনন্য উদাহরণ। বিশেষ করে বাংলাদেশের পেসাররা আবারও প্রমাণ করলেন, তারা এখন আর হোম কন্ডিশনের বাউন্ডারিতে আটকে নেই।
বাংলাদেশ দল আজ যে জয় তুলে নিয়েছে, তা কেবল রান, উইকেট বা পয়েন্টের খতিয়ান নয়—এটা আত্মবিশ্বাসের, সাহসের এবং অসাধারণ দলের সমন্বয়ের প্রতিচ্ছবি। জাকের আলীর স্টেডি ইনিংস, মেহেদীর কার্যকর ব্যাটিং, তানজিম-শরীফুলের আগুনে বোলিং, রিশাদের গুরুত্বপূর্ণ ব্রেকথ্রু এবং মোস্তাফিজের চাপ সামলানোর দক্ষতা—সব মিলিয়ে এটি ছিল একটি পূর্ণাঙ্গ দলীয় পারফরম্যান্স।
এখন অপেক্ষা তৃতীয় ও শেষ ম্যাচের। যদিও সিরিজের ভাগ্য ইতিমধ্যে নির্ধারিত, তবু এই ম্যাচ হতে পারে আরও নতুন তারকা খুঁজে পাওয়ার মঞ্চ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ