
ছবি: সংগৃহীত
ক্ষমতা হারানোর আগ মুহূর্তে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর পরিবারের সদস্য ও নিকট আত্মীয়দের উদ্দেশ্যে এক বিশেষ বার্তা পাঠিয়েছিলেন—এমন দাবি করেছেন তার পরিবারের একজন ঘনিষ্ঠ সদস্য। ওই বার্তার মাধ্যমে শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে অনুরোধ করেছিলেন, যেন তারা অবিলম্বে দেশ ত্যাগ করেন। এতে পরিষ্কারভাবে লেখা ছিল—“নো ওয়ান স্টে হিয়ার”—বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায়, “এখানে কেউ থাকবে না।” সূত্রের দাবি, বার্তাটি ছিল একটি স্পষ্ট ও চূড়ান্ত নির্দেশ, যার পেছনে ছিল নিরাপত্তা, আশঙ্কা ও রাজনৈতিক বিপর্যয়ের সম্ভাবনা।
গোপন নির্দেশের পটভূমি: ৫ আগস্টের আগের সন্ধ্যা
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ দিন। বহু আলোচিত “ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিপ্লব”-এর ফলাফল হিসেবে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতা থেকে বিদায় নেয়। এর আগের দিন, অর্থাৎ ৪ আগস্ট, দেশে কারফিউ চলছিল এবং জনজীবন প্রায় অচল হয়ে পড়েছিল। ঠিক এই সময় শেখ হাসিনা এক গোপন সিদ্ধান্তে উপনীত হন—তাঁর নিকট আত্মীয়দের মধ্যে যারা দেশের ভেতরে ছিলেন, তাদের দ্রুত বিদেশে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন। সেই নির্দেশ মোবাইল বার্তার মাধ্যমে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে পাঠানো হয়, যাতে ছিলেন বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্য, ঘনিষ্ঠ আত্মীয় এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা।
সূত্র বলছে, শেখ হাসিনা কেবলমাত্র তার রক্তসম্পর্কীয় আত্মীয়দের দেশ ত্যাগের নির্দেশ দিয়েছিলেন। দলের নেতাকর্মী বা মন্ত্রিসভার অন্য সদস্যদের কাউকে এই ধরনের বার্তা পাঠানো হয়নি। এতে বোঝা যায়, পরিস্থিতি কতটা সংকটপূর্ণ ছিল এবং প্রধানমন্ত্রীর নিজের নিরাপত্তা ও পরিবারের ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি কতটা উদ্বিগ্ন ছিলেন।
বিদেশে পালিয়ে যাওয়া আত্মীয়দের তালিকা ও অবস্থান
এমন বার্তা পাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু পরিবারের অন্তত একাধিক সদস্য দেশ ত্যাগ করে বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেন। সূত্র বলছে, তারা পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর ও ভারতে। তাদের মধ্যে এক সাবেক সংসদ সদস্য এবং প্রভাবশালী দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থান করছেন। তিনি শেখ হাসিনার দাদা শেখ লুৎফুর রহমানের বংশীয় একজন আত্মীয়।
এই ব্যক্তি তার ঘনিষ্ঠজনদের জানিয়েছেন, শেখ হাসিনার পাঠানো বার্তার সময়োপযোগী প্রতিক্রিয়ার কারণেই তিনি কারাগারে যাওয়া থেকে রক্ষা পেয়েছেন। “যদি দেশ না ছাড়তাম, আজ আমাকে জেলে থাকতে হতো”—এই বক্তব্যের মধ্য দিয়েই বর্তমান বাস্তবতা ও পূর্ববর্তী ক্ষমতাকেন্দ্রিক অস্থিরতা অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে ওঠে।
শেখ রেহানা ও শেখ হাসিনার ভারত গমন
পরিবারের সদস্যদের বিদেশে নিরাপদে পৌঁছে দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে ভারত চলে যান। সেখান থেকে শেখ রেহানা লন্ডনে পাড়ি জমান। তবে শেখ হাসিনা এখন কোথায় অবস্থান করছেন, সে বিষয়ে নিশ্চিত কোনো তথ্য প্রকাশ পায়নি।
বঙ্গবন্ধু পরিবারের একটি ব্যতিক্রম: গ্রেপ্তার হন সেরনিয়াবাত মঈনউদ্দিন
যদিও অধিকাংশ আত্মীয় দেশ ত্যাগে সক্ষম হন, তবে এর ব্যতিক্রমও রয়েছে। বঙ্গবন্ধু পরিবারের একজন সদস্য—সেরনিয়াবাত মঈনউদ্দিন আবদুল্লাহ—গ্রেপ্তার হন ২০২৪ সালের অক্টোবরে। তিনি সাবেক চিফ হুইপ আবুল হাসনাত আবদুল্লাহর পুত্র এবং শেখ হাসিনার ফুপাতো ভাইয়ের সন্তান। বর্তমানে তিনি কারাগারে আছেন এবং তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলোর তদন্ত চলছে।
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ, গ্রেপ্তার শতাধিক নেতা
সরকার পতনের পর বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আওয়ামী লীগের সব ধরনের রাজনৈতিক কার্যক্রম সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। সেই সঙ্গে শুরু হয় একটি ব্যাপক শুদ্ধি অভিযান, যার আওতায় গ্রেপ্তার করা হয় বহু প্রভাবশালী নেতা, সাবেক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের। তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে হত্যা, গুম, দুর্নীতি, অর্থপাচারসহ বিভিন্ন গুরুতর অভিযোগ।
জেলে পাঠানো এসব নেতাদের সঙ্গে শেখ হাসিনার আত্মীয়দের দেশের বাইরে অবস্থান একটি বড় ধরনের রাজনৈতিক ও নৈতিক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সাধারণ জনগণের মধ্যে এ নিয়ে চলছে ব্যাপক আলোচনা—শুধু রক্তসম্পর্কের ভিত্তিতে নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়া কি ন্যায়বিচারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ?
৩ আগস্টের সংকেত: শেখ হাসিনার উপলব্ধি
অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থানরত বঙ্গবন্ধু পরিবারের এক সদস্য জানিয়েছেন, ২০২৪ সালের ৩ আগস্ট বিকেলে শেখ হাসিনা বুঝতে পারেন যে, রাজনৈতিক পরিস্থিতি তার সরকারকে আর ধরে রাখতে পারবে না। তখন তিনি ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের সঙ্গে বৈঠকে বসেন এবং সবাইকে সুরক্ষার প্রস্তুতি নিতে বলেন। এরপরেই হোয়াটসঅ্যাপে ওই বিখ্যাত বার্তাটি পাঠানো হয়।
এত দ্রুত সময়ের মধ্যে আত্মীয়দের দেশ ছাড়ার জন্য এমন উদ্যোগ গ্রহণে স্পষ্ট হয় যে, সরকারের পতন ঘনিয়ে আসার আভাস সেই সময়ই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল এবং শেখ হাসিনা খুব কম সময়ের মধ্যেই তার পরিবারের ভবিষ্যতের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মন্তব্য
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আত্মীয়দের গোপনে বিদেশে পাঠানোর এই নির্দেশ একটি দুর্বল গণতান্ত্রিক চর্চার প্রমাণ। সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা যদি মনে করে থাকেন, কেবল তার পরিবারের সদস্যদের রক্ষা করলেই চলবে, তবে তা ন্যায়বিচারের ধারণার পরিপন্থী। তার এ সিদ্ধান্ত একদিকে যেমন আত্মরক্ষার চেষ্টা, অন্যদিকে তা বিরোধী দল, আন্দোলনকারী জনগণ এবং দেশের প্রতি দায়িত্বহীনতার চিত্র তুলে ধরে।
শেখ হাসিনার ‘নো ওয়ান স্টে হিয়ার’ বার্তা শুধু তার পরিবারের ভেতরেই সীমাবদ্ধ ছিল, যা ২০২৪ সালের রাজনৈতিক পরিবর্তনের আগে এক গভীর সংকটের প্রতিচ্ছবি। আজ, যেসব আত্মীয় বিদেশে অবস্থান করছেন, তারা হয়তো সাময়িক নিরাপদ—তবে ইতিহাসে তারা থাকবেন একটি সরকারের পতনের পূর্ব মুহূর্তের নীরব কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে। বর্তমান বাংলাদেশ সেই ইতিহাসকে মূল্যায়ন করছে নতুন আলোকপাতের দৃষ্টিকোণ থেকে—যেখানে ক্ষমতা, দায়িত্ব ও জনগণের প্রতি জবাবদিহি আবার প্রশ্নবিদ্ধ।
তথ্যসূত্র : খবরের কাগজ
বাংলাবার্তা/এমএইচ