
ছবি: সংগৃহীত
আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তের পর দেশের রাজনীতি এখন এক নতুন এবং অস্থির বাস্তবতার মুখোমুখি। দেশের সর্বোচ্চ নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালনরত প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস রবিবার (২৬ মে) স্পষ্টভাবে বলেছেন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হওয়ার পর দেশের ভেতরে এবং বাইরে আরেকটি যুদ্ধ পরিস্থিতির সূচনা হয়েছে, যার লক্ষ্য হচ্ছে জাতিকে পুনরায় বিভাজনের দিকে ঠেলে দেওয়া এবং দেশের অগ্রগতি রুদ্ধ করা।
জাতীয় সংলাপের অংশ হিসেবে আজ রাজধানীর উপদেষ্টা কার্যালয়ে দেশের কয়েকজন বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে অংশ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা এই মন্তব্য করেন। বৈঠক শেষে তার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এক প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য তুলে ধরেন।
প্রেস সচিব বলেন, “প্রধান উপদেষ্টা স্পষ্ট করে বলেছেন—আমরা এখন একটি বড় যুদ্ধাবস্থার মধ্যে আছি। আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়ার পরে তারা নানা রকমভাবে দেশকে অস্থিতিশীল করতে চাইছে। ডিস্টাবিলাইজেশন চেষ্টার পেছনে সুপরিকল্পিত আন্তর্জাতিক এবং অভ্যন্তরীণ চক্রান্ত কাজ করছে।”
ড. ইউনূসের ভাষায়, “তারা কিছুতেই এটা মেনে নিতে পারছে না যে, ক্ষমতার রাজনীতি থেকে একচেটিয়া আধিপত্যের অবসান ঘটেছে। বিভাজনের এই রাজনীতি থেকে আমাদের মুক্ত হতে হবে। আমাদের ঐকমত্যের ভিত্তিতে সামনে এগোতে হবে।”
ড. ইউনূস বলেন, “আমরা আত্মমর্যাদাপূর্ণ জাতি হিসেবে যেটুকু দাঁড়াতে পেরেছি, সেটাকে ধ্বংস করে আবার যেন আমাদের গোলামির দিকে ঠেলে দেওয়া হয়—এই ষড়যন্ত্র চলছে। আমাদের জাতীয় সংহতির এই মুহূর্তে আর বিভক্তির সময় নেই।”
প্রধান উপদেষ্টা মনে করেন, জাতিকে সংঘবদ্ধ রেখে চলমান সংস্কার প্রক্রিয়া ও বিচারিক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়াই এখন সরকারের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। তিনি বলেন, “আমি যতদিন থাকব, দেশের কোনো অনিষ্ট হবে—এমন কাজ আমার দ্বারা হবে না, এই নিশ্চয়তা আমি জনগণকে দিতে চাই।”
সরকারের মূল লক্ষ্য প্রসঙ্গে প্রেস সচিব বলেন, “এই সরকারের তিনটি মূলমন্ত্র—সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন। আমরা যখন পূর্ণ সংস্কার করতে পারব, তখনই দেশের জনগণের আস্থা পুনঃস্থাপন সম্ভব হবে এবং গণতান্ত্রিক নির্বাচন সফলভাবে অনুষ্ঠিত হবে।”
ড. ইউনূস এর বক্তব্য অনুযায়ী, গণতান্ত্রিক রূপান্তর ও সংস্কারের এই মুহূর্তটি জাতির সামনে ‘মহাসুযোগ’ হিসেবে এসেছে। “অভ্যুত্থানের ধ্বংসাবশেষ থেকে দেশকে টেনে তুলে দাঁড় করানোর এই দায়িত্বকে আমি ব্যক্তিগতভাবে এক ঐতিহাসিক দায় হিসেবে নিচ্ছি,”—বলেন ড. ইউনূস।
জনগণের প্রতীক্ষার কেন্দ্রে রয়েছে আসন্ন নির্বাচনের সময়সূচি। এ বিষয়ে প্রেস সচিব স্পষ্ট করে বলেন, “প্রধান উপদেষ্টা বারবার বলেছেন, ৩০ জুনের পর একটি দিনও তিনি ক্ষমতায় থাকবেন না। নির্বাচন অবশ্যই ৩০ জুনের মধ্যেই সম্পন্ন করতে হবে। নির্ধারিত সময়ের বাইরে নির্বাচন হলে সেটা হবে সংবিধান পরিপন্থী এবং জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা।”
প্রধান উপদেষ্টা জানিয়েছেন, উপযুক্ত সময়ে তিনি নির্বাচনের রোডম্যাপ ও সময়সূচি ঘোষণা করবেন এবং সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে রাজনৈতিক সংলাপের দরজা খোলা থাকবে।
দেশের ভিতরে-বাইরে যে 'ষড়যন্ত্র' চলছে, তার পেছনে কারা আছে, তা নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা সরাসরি কিছু না বললেও তিনি উল্লেখ করেছেন, “তাদের উদ্দেশ্য একটাই—আমরা যেন আবার গোলামিতে ফেরত যাই। আন্তর্জাতিক শক্তি ও দেশীয় স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী মিলে এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করতে চাইছে, যাতে আমাদের সামনে অরাজকতা, অর্থনৈতিক বিপর্যয় এবং সামাজিক দ্বন্দ্ব ছাড়া আর কিছুই না থাকে।”
তিনি বলেন, “এই যুদ্ধে আমরা যদি জিততে চাই, তাহলে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। পরিবার, সমাজ, রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ—সবাইকে এখন এক কণ্ঠে কথা বলতে হবে।”
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হওয়ার পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা এক নতুন বাঁকে মোড় নিয়েছে। পরিস্থিতিকে অনেকে তুলনা করছেন ১৯৭৫ পরবর্তী রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার সঙ্গে। তবে এই বার্তা স্পষ্ট—বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা ধরে রাখতে চায় না; বরং একটি শান্তিপূর্ণ, অবাধ ও সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ঘটিয়ে একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সূচনা করতে চায়।
এই যাত্রায় চ্যালেঞ্জ যেমন আছে, তেমনি সুযোগও বিশাল। দেশের মানুষ এখন ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। সামনে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত, কিন্তু সেই সম্ভাবনা বাস্তবায়নের পথ যে কণ্টকাকীর্ণ—তা আজকের প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে আবারও প্রমাণিত হলো।
বাংলাবার্তা/এমএইচ