
ছবি: সংগৃহীত
সরকারি চাকরি আইন ২০১৮ সংশোধন করে সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি আরোপের সুযোগ রেখে একটি নতুন অধ্যাদেশ জারি করেছে সরকার। সংশোধিত এই অধ্যাদেশে সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা ছাড়াই, মাত্র ১৪ কার্যদিবসের মধ্যে দ্রুত বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করার বিধান রাখা হয়েছে। বিষয়টি সচিবালয়ের হাজার হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে তীব্র উদ্বেগ ও অসন্তোষ তৈরি করেছে, যার ফলে চলমান আন্দোলন আরও জোরালো রূপ নিতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
রোববার (২৬ মে) রাতে আইন মন্ত্রণালয় সরকারি গেজেট আকারে এই অধ্যাদেশটি প্রকাশ করে। 'সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪' শীর্ষক এই অধ্যাদেশ কার্যকর হওয়ার পর থেকেই সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থায় সরকার আরও কঠোর অবস্থানে যাওয়ার সুযোগ পাবে।
অত্যন্ত দ্রুত সময়ের মধ্যে অভিযোগ গঠন, কারণ দর্শানোর নোটিশ ও শাস্তি আরোপের সময়সীমা নির্ধারণ করে এই অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, কোনো অভিযোগ পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীকে ৭ কার্যদিবসের মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিতে হবে। এরপর তার জবাব বিশ্লেষণ করে যদি অভিযোগ প্রমাণিত হয়, তাহলে কেন তাকে দণ্ড দেওয়া হবে না, তা জানাতে আরও ৭ কার্যদিবসের মধ্যে দ্বিতীয় একটি কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হবে। সবমিলিয়ে ১৪ কার্যদিবসের মধ্যেই শাস্তিমূলক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যাবে।
সংশোধিত অধ্যাদেশে সবচেয়ে আলোচিত ও বিতর্কিত অংশ হচ্ছে আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার সীমিত করা। শৃঙ্খলা বিঘ্ন, কর্তব্য পালনে বাধা সৃষ্টি, পূর্বানুমতি ছাড়া ছুটিতে অনুপস্থিত থাকা কিংবা দায়িত্ব পালনে গাফিলতি বা অবহেলার অভিযোগে অভিযুক্ত কর্মচারীর বিরুদ্ধে কোনো শুনানি ছাড়াই চাকরিচ্যুতির মতো কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে।
সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে এটি এক যুগান্তকারী পরিবর্তন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট মহলের অনেকেই। কারণ, এতদিন পর্যন্ত সরকারি চাকরিজীবীদের বিরুদ্ধে যেকোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থায় তদন্ত, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ এবং বিভাগীয় মামলার প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হতো। এই অধ্যাদেশের ফলে সেই নিরাপত্তার বলয় অনেকটাই সংকুচিত হয়ে পড়ছে।
অধ্যাদেশে আরও বলা হয়েছে, দণ্ডপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী রাষ্ট্রপতির দেওয়া শাস্তির বিরুদ্ধে আদালত বা উচ্চ পর্যায়ে আপিল করতে পারবেন না। তবে তিনি রাষ্ট্রপতির কাছেই ‘পুনর্বিবেচনার’ জন্য আবেদন করতে পারবেন, যেটিকে অনেকে কার্যত আপিলের অধিকার হরণ বলেই মনে করছেন।
এই সীমিত আপিলব্যবস্থার বিষয়টি নিয়েও তীব্র আপত্তি জানিয়েছে সরকারি কর্মচারীদের বিভিন্ন সংগঠন। তাদের ভাষ্য, এটি সরকারি চাকরিতে সাংবিধানিক রক্ষাকবচ নষ্ট করবে এবং কর্তাব্যক্তিদের একচ্ছত্র ক্ষমতার সুযোগ তৈরি করবে।
এমন সময় অধ্যাদেশটি প্রকাশ করা হলো, যখন সচিবালয়জুড়ে কর্মচারীরা এই সংশোধনীর বিরুদ্ধে লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। গত কয়েক দিন ধরে তারা কর্মবিরতি পালন করছেন। সচিবালয়ের বিভিন্ন ভবনের সামনেই তাদের অবস্থান কর্মসূচি ও বিক্ষোভ চলছে।
তাদের দাবি, এই অধ্যাদেশ সংশোধনের মাধ্যমে সরকার চাকরিজীবীদের মৌলিক অধিকার খর্ব করছে এবং একতরফাভাবে শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা দিয়ে ভয়ভীতি ও দমননীতি চালু করতে চাইছে।
এর আগে গত ২২ মে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে অধ্যাদেশের খসড়া অনুমোদন দেওয়া হয়। এরপর এটি আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং (আইনগত যাচাই) শেষে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন নিয়ে আজ গেজেট আকারে প্রকাশিত হলো। এর আগে প্রকাশনার আগেই খবর ছড়িয়ে পড়লে সচিবালয়ের কর্মচারীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি হয়।
অধ্যাদেশের বিরোধিতায় ইতোমধ্যে একাধিক দফায় প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সচিবালয় কর্মচারীদের প্রতিনিধিদের বৈঠক হলেও সেগুলোর কোনো সমাধান আসেনি।
সচিবালয় কর্মচারী কল্যাণ পরিষদ ও অন্যান্য সংগঠনের নেতারা জানিয়েছেন, এই অধ্যাদেশ প্রত্যাহার না করা হলে তারা পর্যায়ক্রমে আরও কঠোর কর্মসূচিতে যাবেন। এর মধ্যে কর্মবিরতি, অবস্থান কর্মসূচি, সচিবালয়ের বিভিন্ন ভবনে তালা দেওয়া, এমনকি অনশন পর্যন্ত বিবেচনা করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
নেতারা অভিযোগ করেছেন, সরকার প্রশাসনে ভীতি সৃষ্টি করতে চায়। "কেউ যেন সরকারি দুর্নীতি বা অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা না বলে, কেউ যেন কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন না তোলে—সেজন্যই এই আইন আনা হয়েছে," বলেন এক বিক্ষুব্ধ কর্মচারী নেতা।
প্রশাসন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, সরকারি চাকরিজীবীদের আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার হরণ এবং সীমিত আপিলব্যবস্থা সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘনের শামিল হতে পারে। কোনো তদন্ত ছাড়াই একজন কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করা হলে, তা হয়তো ভবিষ্যতে উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জ হতে পারে।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেছিলেন, "দায়িত্বশীল প্রশাসন গড়তে হলে অবশ্যই শৃঙ্খলার দরকার, কিন্তু তা হতে হবে সুবিচার ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে। ক্ষমতা দিয়ে যদি ভয় দেখানো হয়, তাহলে সেটি কেবল প্রশাসন নয়, রাষ্ট্র ব্যবস্থার জন্যও ক্ষতিকর।"
সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, অধ্যাদেশটি সরকারি কর্মচারীদের শাস্তির ক্ষেত্রে কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ব্যাপক অসন্তোষের জন্ম দিয়েছে। প্রশাসনের একটি বড় অংশ এই অধ্যাদেশকে ‘স্বৈরাচারী মনোভাবের প্রকাশ’ হিসেবে দেখছে। সরকার যদি দ্রুত আলোচনার মাধ্যমে কর্মচারীদের আশ্বস্ত করতে না পারে, তাহলে সামনে আরও বৃহৎ আন্দোলন ও প্রশাসনিক অচলাবস্থার শঙ্কা তৈরি হতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ