
ছবি: সংগৃহীত
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা আজ রোববার শুভ মহালয়ার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হলো। মহালয়া মানেই পিতৃপক্ষের অবসান ও দেবীপক্ষের সূচনা। ভোর সাড়ে ৫টায় চণ্ডীপাঠ, ঢাক–কাঁসর ও শঙ্খধ্বনির মধ্য দিয়ে দেবী দুর্গাকে মর্ত্যে আহ্বান জানানোর মধ্য দিয়ে সারা দেশে শুরু হয়েছে দেবী বন্দনার মহাউৎসব।
প্রতিবছর শরৎকালে কৈলাস পর্বত থেকে মা দুর্গার আগমনকে কেন্দ্র করে বাংলার গ্রাম থেকে শহর—সবখানেই ভক্তদের মধ্যে সৃষ্টি হয় আনন্দ-উল্লাসের পরিবেশ। এই উপলক্ষে রাজধানীসহ সারা দেশের পূজামণ্ডপগুলো এখন সাজসজ্জায় আলোকোজ্জ্বল। ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির, রমনা কালীমন্দির, রাজারবাগ কালীমন্দির, রামকৃষ্ণ মিশনসহ প্রধান প্রধান মন্দিরগুলোয় দিনরাত চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। বেশির ভাগ মণ্ডপে প্রতিমা নির্মাণ শেষ পর্যায়ে, এখন চলছে রংতুলি ও সাজসজ্জার কাজ।
রমনা কালীমন্দিরের শিল্পী রতন পাল জানান, প্রতিমা তৈরির কাজ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। এখন রঙ করার কাজ চলছে, এরপর শুরু হবে প্যান্ডেলের নকশা ও সাজসজ্জা। মন্দির কর্তৃপক্ষ বলছে, ভক্ত ও দর্শনার্থীদের নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে প্রশাসনের সর্বাত্মক সহযোগিতা মিলছে।
মহালয়াকে দুর্গোৎসবের তিনটি প্রধান পর্বের একটি হিসেবে ধরা হয়। বাকি দুটি হলো বোধন ও সন্ধিপূজা। এ বছর মহাষষ্ঠী পূজা হবে ২৮ সেপ্টেম্বর, মহাসপ্তমী ২৯ সেপ্টেম্বর, মহাষ্টমী ৩০ সেপ্টেম্বর, মহানবমী ১ অক্টোবর এবং বিজয়া দশমী ২ অক্টোবর। ওই দিন প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হবে পাঁচ দিনের শারদীয় দুর্গোৎসব, আর দেবী ফিরে যাবেন কৈলাসে।
রমনা কালীমন্দিরের পুরোহিত হরিচাঁদ চক্রবর্তী জানান, মহালয়ার ভোরেই দেবীর মর্ত্যে আগমন ঘটে। এরপর পূজার প্রতিটি দিনই আলাদা তাৎপর্য বহন করে। ভক্তরা নিয়মিত চণ্ডীপাঠ, আরতি, মঙ্গলঘট স্থাপনসহ নানা আচার পালন করবেন। একই সঙ্গে অনেক ভক্ত পিতৃপুরুষদের স্মরণে পিণ্ডদান ও প্রার্থনা করবেন।
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত বছর সারা দেশে ৩২ হাজার ৬৬৬টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এবার সেই সংখ্যা আরও এক হাজার বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। শুধু রাজধানীতেই এবার ২৫২টি মণ্ডপে পূজার আয়োজন করা হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে পূজা উদযাপন পরিষদের নেতারা ইতোমধ্যে বৈঠক করেছেন। জেলা প্রশাসনগুলোও প্রস্তুতিমূলক সভা করেছে। পূজামণ্ডপের নিরাপত্তা, আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং নির্বিঘ্ন পরিবেশে উৎসব সম্পন্ন করতে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
যদিও সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে, তবুও দুর্গাপূজা ঘিরে নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে। নাগরিক সমাজের নতুন প্ল্যাটফর্ম ‘সম্প্রীতি যাত্রা’ দেশের ২৯টি জেলাকে ‘ঝুঁকিপ্রবণ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে ঢাকা, রংপুর, যশোর, চাঁদপুর ও নোয়াখালীকে রাখা হয়েছে ‘উচ্চঝুঁকিতে’।
সম্প্রীতি যাত্রার সংগঠক ও গবেষক মীর হুযাইফা আল-মামদূহ বলেন, “চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পরও ধর্মীয় উৎসবগুলো ঘিরে ঝুঁকি পুরোপুরি কমেনি। তবে সামাজিক সম্প্রীতি রক্ষায় সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকলে দুর্গাপূজা উৎসব নিরাপদেই উদযাপিত হবে।”
আইজিপি বাহারুল আলম আশ্বস্ত করে জানিয়েছেন, পূজা উপলক্ষে দেশজুড়ে তিন স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। পুলিশ প্রাক-পূজা, পূজা চলাকালীন এবং প্রতিমা বিসর্জন-পরবর্তী সময়েও কড়াকড়ি নজরদারি চালাবে। পূজাকেন্দ্রিক নিরাপত্তা কার্যক্রম ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে।
ঢাকার পাশাপাশি চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, রংপুরসহ প্রতিটি বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরে চলছে উৎসবের প্রস্তুতি। গ্রামাঞ্চলেও পূজামণ্ডপ সাজাতে ব্যস্ত শিল্পী ও আয়োজকরা। ভক্তরা বলছেন, মহালয়ার ভোর থেকেই তাঁদের মনে জেগে ওঠে শারদীয় আনন্দ।
পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি বাসুদেব ধর বলেন, “বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপূজা। প্রতিমা নির্মাণ থেকে শুরু করে প্যান্ডেলের সাজসজ্জা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ—সব ক্ষেত্রেই আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছি। সরকারের সহযোগিতাও পাচ্ছি।”
এভাবে শুভ মহালয়ার সূচনায় শুরু হলো দেবী বন্দনার দিনগণনা। ভক্তরা এখন প্রতীক্ষায় মা দুর্গার মহাষষ্ঠীর বোধনের, যা শুরু করবে পাঁচ দিনের পূর্ণাঙ্গ পূজা আর আনন্দঘন উৎসব।
বাংলাবার্তা/এমএইচ