
ছবি: সংগৃহীত
প্রতি বছর মে মাসে ফ্রান্সের রিভিয়েরার ছোট্ট কিন্তু চমৎকার উপকূলীয় শহর কানে যখন বিশ্ব সিনেমার সর্বশ্রেষ্ঠ তারকারা, নির্মাতারা, সাংবাদিকেরা এবং ফ্যাশন আইকনরা একত্রিত হন, তখন সেই আয়োজন আর কেবল একটি উৎসব থাকে না—তা হয়ে ওঠে বৈশ্বিক সংস্কৃতির সেতুবন্ধন, শিল্পের সর্বোচ্চ উদযাপন এবং ঐতিহাসিক গৌরবের ধারক। কান চলচ্চিত্র উৎসবের রেড কার্পেটটি হয়ে উঠেছে সেই সম্মিলিত গৌরবের প্রতীক, যেখানে একটি একটি পদক্ষেপ মানে স্বীকৃতি, ইতিহাস এবং নতুন ভবিষ্যতের প্রতিফলন।
কান শহর এবং চলচ্চিত্র উৎসবের আত্মপ্রকাশ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে দাঁড়ানো এক বিষণ্ণ, বিভাজিত ইউরোপে তখন আশার চিহ্ন খুবই প্রয়োজন ছিল। সেই সময়েই, ১৯৪৬ সালে, ফরাসি সরকার এবং কিছু দূরদর্শী সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের উদ্যোগে যাত্রা শুরু করে Festival de Cannes বা কান চলচ্চিত্র উৎসব। এই শহরটি নির্বাচন করা হয় একাধিক কারণে: ভৌগোলিকভাবে শান্ত, সুরম্য উপকূল; দক্ষিণ ফ্রান্সের উষ্ণ আতিথেয়তা; এবং সর্বোপরি, যুদ্ধ বিধ্বস্ত ইউরোপকে সংস্কৃতির মাধ্যমে পুনরুত্থান ঘটানোর আকাঙ্ক্ষা।
শুরুটা ছিল নিভৃত, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এই উৎসব হয়ে ওঠে বিশ্ব চলচ্চিত্রের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ ও গৌরবময় আয়োজন। আজ এটি এমন এক প্ল্যাটফর্ম যেখানে শুধুমাত্র সিনেমা নয়, সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতি, প্রতিবাদ, ফ্যাশন, ঐতিহ্য ও ভবিষ্যতের ট্রেন্ড একসূত্রে গাঁথা হয়।
রেড কার্পেট: গ্ল্যামার, বার্তা এবং ঐতিহ্যের মঞ্চ
রেড কার্পেট বা লাল গালিচার ইতিহাস অনেক পুরনো। প্রাচীন গ্রিসে রাজপরিবারের সদস্যদের জন্য লাল গালিচা বিছানো হতো। আধুনিক ইতিহাসে, প্রথম উল্লেখযোগ্য রেড কার্পেট দেখা যায় ১৯০২ সালে, নিউ ইয়র্ক সেন্ট্রাল রেলওয়ের এক অভিজাত রুটে। এরপর ধীরে ধীরে এই রঙ ও প্রথা ছড়িয়ে পড়ে, এবং ১৯৫৫ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে রেড কার্পেট চালু হলে তা হয়ে ওঠে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির প্রতীক।
কান-এর লাল গালিচার দৈর্ঘ্য প্রায় ৬০ মিটার। দিনে একাধিকবার নতুন গালিচা বিছানো হয় যাতে প্রতিটি পদক্ষেপই থেকে যায় নিখুঁত। রেড কার্পেটে প্রবেশের জন্য কড়া ড্রেস কোড—পুরুষদের জন্য ব্ল্যাক টাই এবং নারীদের জন্য দীর্ঘ গাউন বাধ্যতামূলক। আমন্ত্রণপত্র ছাড়া কেউ প্রবেশ করতে পারে না। এখানে শুধুমাত্র সিনেমার জগতের মানুষই নয়, সমাজের পরিবর্তনের বার্তা বহনকারীরাও স্বাগত পান।
রেড কার্পেট শুধুই গ্ল্যামারের প্রদর্শন নয়, এটি এক সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ভাষা। কেউ যুদ্ধবিরোধী বার্তা নিয়ে আসে গাউনের মাধ্যমে, কেউ নারীর ক্ষমতায়নকে তুলে ধরে, কেউ আবার নিজ দেশের ঐতিহ্য তুলে ধরে বিশ্বদর্শনের সামনে।
কেন কান এত গুরুত্বপূর্ণ?
চলচ্চিত্রশিল্পের বৈশ্বিক কেন্দ্র: এখানে বিশ্বজুড়ে প্রতিভাবান নির্মাতা, শিল্পী ও প্রযোজকেরা তাঁদের চলচ্চিত্র উপস্থাপন করেন।
সৃজনশীলতার মেলা: কান ফিল্ম মার্কেট পৃথিবীর অন্যতম বড় চলচ্চিত্র ব্যবসার মঞ্চ, যেখানে শতাধিক দেশের প্রযোজক ও ডিস্ট্রিবিউটর অংশ নেন।
রুচির বিকাশ: আর্ট হাউস, ইন্ডিপেনডেন্ট, কমার্শিয়াল এবং ক্লাসিক সব ধরণের চলচ্চিত্র এখানে গুরুত্ব পায়।
সম্মাননা ও প্রতীকী বার্তা: ‘Palme d'Or’ থেকে শুরু করে 'Un Certain Regard' পর্যন্ত প্রতিটি পুরস্কার শিল্পী ও শিল্পের মর্যাদা বৃদ্ধি করে।
ইতিহাসের স্মরণীয় অধ্যায়: কিংবদন্তিরা যাঁরা কানে আলো ছড়িয়েছেন
লুই লুমিয়ের – সিনেমাটোগ্রাফি আবিষ্কারের পথিকৃৎ হিসেবে সম্মানিত।
অ্যাগনেস ভার্দা – নারীকেন্দ্রিক ফরাসি নিউ ওয়েভ সিনেমার প্রবর্তক।
ফ্রাঁসোয়া ট্রুফো – নতুন তরঙ্গ আন্দোলনের পথিকৃৎ, যাঁর কাজগুলো আজও পাঠ্যবইয়ে স্থান পায়।
কুয়েন্টিন টারান্টিনো – ‘Pulp Fiction’-এর মাধ্যমে কানের ইতিহাসে নতুন ধারার সূচনা।
মার্টিন স্করসেজি – বিশ্ব চলচ্চিত্রের রূপান্তরকারী নির্মাতা।
ঐশ্বরিয়া রাই – যিনি ভারতের ঐতিহ্যকে বিশ্ব ফ্যাশন এবং চলচ্চিত্র মঞ্চে তুলে ধরেছেন।
কান উৎসবের গৌরবোজ্জ্বল মুহূর্তগুলো
১৯৯৪: ‘Pulp Fiction’ পাম ডি'অর জিতে কুয়েন্টিন টারান্টিনো হয়ে ওঠেন কাল্ট আইকন।
২০০২: ঐশ্বরিয়া রাই তাঁর শাড়ির মাধ্যমে রেড কার্পেটে ভারতীয় ঐতিহ্যকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরেন।
২০১৮: নারী জুরি সদস্যরা হাতে হাত রেখে রেড কার্পেটে হেঁটে নারীর সমঅধিকারের বার্তা দেন।
২০২৫: আলিয়া ভাটের ফিউশন পোশাক সামাজিক বার্তা ও শৈল্পিকতা একত্র করে।
২০২৫: এক ঐতিহাসিক অধ্যায় এবং বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা
২০২৫ সালের কান চলচ্চিত্র উৎসব ছিল এক নান্দনিক বিপ্লব। এখানে প্রথাগত ধারার বাইরে, নতুন চিন্তা এবং নতুন মুখ বিশ্বের সামনে তুলে ধরা হয়। আর এই বছরে সবচেয়ে গর্বের বিষয় ছিল বাংলাদেশের অংশগ্রহণ। পরিচালক আদনান আল রাজীবের ছবি ‘আলি’ বিশেষ সম্মাননা পায়—যা শুধু তার ব্যক্তিগত সাফল্য নয়, বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও বটে।
‘আলি’: বঞ্চনার বাস্তবতা থেকে সাহসিকতার আলোকছটা
‘আলি’ এমন এক সিনেমা যা একজন প্রান্তিক তরুণের অভিবাসন, পরিচয় সংকট, সংগ্রাম এবং মানবিক জয়ের কাহিনি বলে। একদিকে যেমন এটি গভীর রাজনৈতিক বাস্তবতাকে চিত্রিত করে, অন্যদিকে তা এক মানবিক আত্মার খোঁজ। ‘আলি’ আন্তর্জাতিক দর্শকদের মনে রেখাপাত করেছে তার বিশুদ্ধ মানবিকতা, নিখুঁত শিল্পনির্মাণ এবং আবেগী উপস্থাপনায়।
এ ছবির মাধ্যমে বাংলাদেশ দেখিয়েছে, দেশের গল্প বলেও বিশ্ব মঞ্চে প্রভাব বিস্তার করা যায়। চলচ্চিত্রের ভাষা যদি আন্তর্জালের মতো বিস্তৃত হয়, তবে ‘আলি’ তার মধ্য দিয়ে সংযোগ ঘটিয়েছে গ্রামীণ বাস্তবতা থেকে বিশ্বজনীন বোধের মধ্যে।
ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টিপাত
কানের লাল গালিচা প্রতিবারই শুধু সেলিব্রিটি ও ফ্যাশনের প্রদর্শনী নয়, এটি বিশ্বজুড়ে সংস্কৃতির সংযোগস্থল। এখান থেকেই শুরু হয় নতুন আলোচনার, প্রতিবাদের, পরিবর্তনের সূচনা। বাংলাদেশ, যেভাবে ‘আলি’র মাধ্যমে এই গালিচায় পা রাখল, তা শুধু একটি মাইলফলক নয়, বরং ভবিষ্যতের দিগন্ত উন্মোচনের একটি বার্তা।
আজকের বাংলাদেশ আর শুধু দক্ষিণ এশিয়ার একটি উন্নয়নশীল দেশ নয়—এটি এখন একটি গল্প বলার শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম। এবং কানের রেড কার্পেট সেই গল্পকে পৌঁছে দেয় বিশ্ববাসীর হৃদয়ে।
কান উৎসবের রেড কার্পেট শুধুই একটি পথ নয়—এটি ইতিহাসের, সাহসিকতার, স্বপ্নের আর সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণের এক দীর্ঘ ও দীপ্ত ভ্রমণ। এবং সেই ভ্রমণে আজ বাংলাদেশের নামও জ্বলজ্বল করে জ্বলছে—‘আলি’-র দীপ্তিতে, আদনান আল রাজীবের ভিশনে এবং রূপকথার মতো এক বাস্তবতায়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ