
ছবি: সংগৃহীত
বাংলা নাটক ও চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন আবারও আলোচনায় এসেছেন এক গভীর, আত্মবিশ্লেষণমূলক স্ট্যাটাসের মাধ্যমে। রবিবার ভোরে নিজের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দেওয়া দীর্ঘ এক লেখায় তিনি জানিয়েছেন—জীবনের এক সময় তিনি চেষ্টা করেছিলেন সেই নারী হতে, যাকে সমাজ, পরিবার কিংবা চারপাশের মানুষ দেখতে চেয়েছিল। কিন্তু সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করেন তিনি। তবে এই ‘ব্যর্থতা’ নিয়েই আজ তিনি শান্তিতে আছেন, স্বাধীন আছেন, এবং নিজের মতো করে বাঁচছেন— এমনটাই জানিয়েছেন এই অভিনেত্রী।
বাঁধনের লেখা শুরু হয় এক নিঃশব্দ স্বীকারোক্তি দিয়ে— “আমি এমন একজন মেয়ে হতে চেয়েছিলাম, যে সবাইকে খুশি রাখে—যে অনুগত, বাধ্য, শান্তভাবে মানিয়ে নেয়। কিন্তু আমি ব্যর্থ হয়েছি।”
তিনি আরও লিখেছেন, “আমি সেই মানুষটা হতে পারিনি, যাকে সবাই দেখতে চেয়েছিল। আমি চেষ্টা করেছিলাম, সত্যি করেছিলাম। চেষ্টা করেছিলাম পরিবারের প্রত্যাশিত মেয়ে হতে, চেষ্টা করেছিলাম সমাজের বানানো ‘নারী’ হতে। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছি। আর সেই ব্যর্থতার জন্য আজ নিজেকেই ধন্যবাদ জানাই।”
এই লেখার মাধ্যমে বাঁধন যেন সমাজের প্রচলিত নারীবোধ ও নারীর প্রতি প্রত্যাশার কাঠামোকে প্রশ্ন করেছেন। তিনি লিখেছেন, “আমি অন্য কারও স্ক্রিপ্টে বাঁচার জন্য জন্মাইনি। আমার কথা অনেকের কাছে অস্বস্তিকর, আমার কাজ অনেকের সান্ত্বনার সীমা ভেঙে দেয়। আমি সহজ মানুষ নই, কিন্তু নির্মমও নই। আমি কাউকে আঘাত দিই না, অসম্মানও করি না—যদিও অনেকেই আমার প্রতি তা করে।”
তার এই কথাগুলো যেন এক আত্মমুক্ত নারীর জীবনের মর্মস্পর্শী প্রতিচ্ছবি—যিনি সমাজের শৃঙ্খল ভেঙে নিজের সত্যিকারের পরিচয় খুঁজে পেয়েছেন।
চলতি মাসের শেষে ৪২ বছরে পা দিচ্ছেন আজমেরী হক বাঁধন। জীবনের এই পর্যায়ে এসে তিনি বলছেন, অবশেষে তিনি শান্তি খুঁজে পেয়েছেন। তার ভাষায়, “চল্লিশের পর এসে আমি নিজের সঙ্গে শান্তিতে আছি। এখন আমি বাঁচি আমার মতো করে—স্বাধীনভাবে, সৎভাবে, বিনা ক্ষমাপ্রার্থনায়।”
এই পর্যায়ে এসে বাঁধনের কণ্ঠে পাওয়া যায় এক দৃঢ় নারীর আত্মবিশ্বাস— “কেউ এতে কষ্ট পেলে, উপেক্ষা করুক, ব্লক করুক, ঘৃণা করুক—আমার কিছু আসে যায় না। কারণ, যাদের আমি অস্বস্তিতে ফেলি, তাদের পাশাপাশি আছে অনেকেই, যারা আমাকে ভালোবাসে, বোঝে, আমার সত্যে শক্তি খুঁজে পায়।”
তিনি আরও লিখেছেন, “সবচেয়ে বড় কথা—আমি নিজেকে ভালোবাসি।” “আমি ভাঙা নই, আমি অস্বস্তিকর”
নিজের পোস্টের শেষ অংশে বাঁধন যেন এক নতুন নারীর সংজ্ঞা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, “আমি ভাঙা নই। আমি শুধু এমন এক পৃথিবীর কাছে অস্বস্তিকর, যে পৃথিবী এখনো আসল নারীকে ভয় পায়।”
নিজেকে উদ্দেশ্য করে তিনি লিখেছেন, “ভালোবাসি তোমায়, আজমেরী হক বাঁধন। তুমি যে নারী হতে চেয়েছিলে, শেষ পর্যন্ত তুমি সেই নারীই হয়েছো।”
বাঁধনের এই স্ট্যাটাস সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দ্রুত ভাইরাল হয়ে পড়েছে। অসংখ্য নারী ও তরুণী তার এই বক্তব্যের সঙ্গে নিজেদের মেলাতে পেরেছেন। মন্তব্যের ঘরে অনেকেই লিখেছেন—“তুমি আমাদের সাহস দাও”, “তোমার সত্যিকারের কণ্ঠ আমাদের অনুপ্রেরণা।”
আজমেরী হক বাঁধন দীর্ঘ অভিনয়জীবনে নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন। ব্যক্তিগত জীবনে সংগ্রামের মধ্য দিয়েও তিনি নিজের অবস্থানকে শক্ত করেছেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোচিত ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী প্রশংসা পেয়েছেন তিনি। সেই চরিত্রের মতোই বাস্তব জীবনের বাঁধনও এক প্রতিবাদী নারী, যিনি নিজের পথ নিজেই তৈরি করেছেন।
তার সর্বশেষ এই লেখাটি তাই কেবল এক ব্যক্তির আত্মপ্রকাশ নয়—বরং এটি এক সামাজিক বার্তা, এক নারীসত্তার পুনর্নির্মাণের ঘোষণা।
আজমেরী হক বাঁধন হয়তো সমাজের “প্রত্যাশিত নারী” হতে পারেননি, কিন্তু তিনি হয়েছেন নিজের মতো করে সত্যিকার একজন নারী—যিনি আত্মমর্যাদা, স্বাধীনতা ও ভালোবাসার মূর্ত প্রতীক।
তার নিজের ভাষায়— “আমি এখন আমার মতো করে বাঁচি—স্বাধীনভাবে, সৎভাবে, বিনা ক্ষমাপ্রার্থনায়।”
বাংলাবার্তা/এমএইচ