
ছবি: সংগৃহীত
দীর্ঘদিন ধরে চলমান ছয় দফা দাবিতে আন্দোলনে থাকা বাংলাদেশের কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন স্থগিতের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করেছে। বুধবার (২৩ এপ্রিল) ‘কারিগরি ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশ’ নামক শিক্ষার্থীদের কেন্দ্রীয় জোট এক বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে এ ঘোষণা দিয়েছে। এর মাধ্যমে আবারো উত্তপ্ত হতে চলেছে দেশের কারিগরি শিক্ষাঙ্গন, বিশেষ করে পলিটেকনিক ও মনোটেকনিক ইনস্টিটিউটসমূহ।
বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচি ও নির্দেশনা আগামীকাল বৃহস্পতিবার কারিগরি ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশের প্রতিনিধি সম্মেলনের মাধ্যমে জানানো হবে। তারা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে, দাবিগুলো বাস্তবায়নের সুস্পষ্ট রূপরেখা না পাওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া হবে।
কেন্দ্রীয় প্রতিনিধির ‘স্থগিত’ ঘোষণার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ইউটার্ন
মঙ্গলবার (২২ এপ্রিল) রাতেই কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি আশরাফুল ইসলাম মিশান একটি সাক্ষাৎকারে আন্দোলন স্থগিতের কথা জানান। সেই ঘোষণার একদিন না যেতেই আজ বুধবার আন্দোলন স্থগিতের সেই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেয়া হলো, যা ছাত্র সমাজে নতুন করে উত্তেজনা ও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
এই পরিস্থিতি স্পষ্ট করছে, সিদ্ধান্তটি হয়তো পর্যাপ্ত আলোচনা ছাড়াই নেওয়া হয়েছিল, অথবা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ভেতরে মতবিরোধ রয়েছে।
শিক্ষার্থীদের দাবির সারসংক্ষেপ
ছয় দফা দাবিতে চলা এই আন্দোলনের মূল ভিত্তি হলো কারিগরি শিক্ষাকে আরও কার্যকর, আধুনিক ও উচ্চশিক্ষার সঙ্গে যুক্ত করার ব্যাপারে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ। তাদের দাবিগুলো কারিগরি শিক্ষা ও পেশাজীবনের গুরুত্বপূর্ণ অসংগতি, বৈষম্য এবং অব্যবস্থাপনার দিকে নির্দেশ করে।
১. ক্রাফট ইনস্ট্রাক্টরদের অবৈধ পদোন্নতি বাতিল:
শিক্ষার্থীদের প্রধান দাবি হলো জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর পদে ক্রাফট ইনস্ট্রাক্টরদের পদোন্নতিকে হাইকোর্ট কর্তৃক অবৈধ ঘোষণা করতে হবে। একই সঙ্গে তাদের পদবি পরিবর্তন করে বিতর্কিত নিয়োগপ্রাপ্তদের চাকরিচ্যুত করতে হবে। ২০২১ সালের ‘রাতের আঁধারে’ দেওয়া নিয়োগ বাতিল করতে হবে এবং সেই নিয়োগবিধি সংশোধন করতে হবে।
২. ভর্তি নীতিমালায় পরিবর্তন ও আধুনিক কারিকুলাম:
ডিপ্লোমা ইন-ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে যেকোনো বয়সে ভর্তির সুযোগ বাতিল করে উন্নত বিশ্বের মতো চার বছর মেয়াদি মানসম্পন্ন কারিকুলাম চালু করার দাবি জানানো হয়েছে। পাশাপাশি একাডেমিক কার্যক্রম ধাপে ধাপে ইংরেজি মাধ্যমে চালুর সুপারিশ করা হয়েছে।
৩. চাকরিতে বৈষম্যের অবসান:
সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের উপযুক্ত গ্রেডে নিয়োগ নিশ্চিত না করে নিম্ন পদে নিয়োগ দেওয়ার প্রতিবাদ জানিয়ে দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানানো হয়েছে।
৪. প্রশাসনিক পদে কারিগরি শিক্ষকদের অগ্রাধিকার:
কারিগরি শিক্ষা বোর্ড এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে অকারিগরি পেশাজীবীদের নিয়োগ নিষিদ্ধ করতে হবে। পরিবর্তে আইনত বাধ্যতামূলকভাবে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত জনবল নিয়োগ দিতে হবে। বোর্ড চেয়ারম্যান, উপসচিব, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, অধ্যক্ষ প্রভৃতি পদে কারিগরি অভিজ্ঞদের নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
৫. পৃথক ‘কারিগরি ও উচ্চশিক্ষা’ মন্ত্রণালয় গঠন:
কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব বিবেচনায় একটি স্বাধীন ‘কারিগরি ও উচ্চশিক্ষা’ মন্ত্রণালয় গঠন ও একটি ‘কারিগরি শিক্ষা সংস্কার কমিশন’ গঠনের দাবি উত্থাপন করা হয়েছে।
৬. টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চশিক্ষার সুযোগ:
পলিটেকনিক ও মনোটেকনিক থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের জন্য একটি টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি করা হয়েছে। পাশাপাশি নড়াইল, নাটোর, খাগড়াছড়ি ও ঠাকুরগাঁওয়ে নির্মাণাধীন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলোতে অস্থায়ী ক্যাম্পাস চালুর মাধ্যমে ১০০% ভর্তি নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
শিক্ষামন্ত্রণালয়ের পদক্ষেপ ও শিক্ষার্থীদের প্রতিক্রিয়া
এই দাবিগুলো বিবেচনায় নিয়ে মঙ্গলবার শিক্ষা মন্ত্রণালয় আট সদস্যবিশিষ্ট একটি যাচাই-বাছাই কমিটি গঠনের ঘোষণা দেয়। তবে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, এই কমিটির কার্যক্রম কিংবা গঠনতন্ত্রে তাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি। তারা মনে করছেন, এটি আন্দোলন দমন করার একটি কৌশল মাত্র।
কারিগরি ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্ররা জানিয়েছেন, “আমরা সময় বেঁধে দিয়েছিলাম। কিন্তু স্পষ্ট কোনো আশ্বাস বা রূপরেখা ছাড়া একটি কমিটি গঠন করে আমাদের আন্দোলন স্থগিত রাখতে বলা হয়েছিল। এখন আমরা বুঝেছি—এটি ছিল রাজনৈতিক আশ্বাস, বাস্তবতার প্রতিফলন নয়।”
ঢাকাসহ সারা দেশে আন্দোলনের প্রস্তুতি
আজকের ঘোষণার পর দেশের বিভিন্ন পলিটেকনিক ও মনোটেকনিক ইনস্টিটিউটে আবারো বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, তারা মাঠে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন এবং বৃহৎ কর্মসূচির জন্য দেশব্যাপী সংগঠিত হচ্ছেন।
কারিগরি শিক্ষার মান উন্নয়ন ও এর সুশাসন নিশ্চিত করতে শিক্ষার্থীদের এই দাবিগুলো সময়োপযোগী বলেই মনে করছেন শিক্ষানবিশ ও পেশাজীবীরা। তবে সরকারের কাছ থেকে কার্যকর পদক্ষেপ না এলে আগামী দিনগুলোতে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে। আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা প্রত্যাহার করায় তাৎক্ষণিকভাবে সরকারের ওপর চাপ বাড়লো বলেই রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত।
বাংলাবার্তা/এমএইচ