
ছবি: সংগৃহীত
গত অর্থবছরে বাংলাদেশের কৃষিপণ্য রপ্তানি সামগ্রিকভাবে কিছুটা উন্নতি হলেও ভারতের বাজারে রপ্তানি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাওয়ার খবর এসেছে। এর পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ হলো ভারতের স্থলবন্দরগুলোতে প্রক্রিয়াজাত খাবার, পোশাক, ফলমূল ও কোমল পানীয়সহ বিভিন্ন পণ্যের রপ্তানিতে একপ্রকার নিষেধাজ্ঞার বিধান। ভারতে রপ্তানি বিশেষ করে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য খাতে এই নিষেধাজ্ঞার প্রভাব সরাসরি পড়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা ও বিশেষজ্ঞরা।
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের স্থলবন্দর বাণিজ্যের অবস্থা গত বছর থেকে বেশ খারাপের দিকে যায়। শুধু ভোমরা স্থলবন্দর ছাড়া অন্য সব স্থলবন্দর দিয়ে রপ্তানি বন্ধ করে দেয়া হয়। ফলে, এসব পণ্য এখন একমাত্র ভোমরা বন্দরের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ গত অর্থবছরে ৯৮৯ মিলিয়ন ডলার মূল্যের কৃষিপণ্য রপ্তানি করেছে, যা আগের বছরের ৯৬৪ মিলিয়ন ডলারের তুলনায় সামান্য বেড়েছে। তবে, শুকনো খাদ্যপণ্য রপ্তানি আগের বছরের একই সময়ে ১৪ শতাংশ কমেছে, চিনি ও কনফেকশনারি পণ্য রপ্তানি ১৭ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
ভারতে কৃষিপণ্য রপ্তানি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মাত্র ১৪৫ মিলিয়ন ডলার হয়েছে, যা এর আগের বছরের ১৯২ মিলিয়ন ডলারের থেকে প্রায় ২৫ শতাংশ কম। ইপিবির পক্ষ থেকে এই পতনের সরাসরি কারণ হিসেবে স্থলবন্দরগুলোতে নিষেধাজ্ঞাকে উল্লেখ করা হচ্ছে।
রপ্তানিকারকরা বলছেন, স্থলবন্দরগুলোতে একমাত্র ভোমরার ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় জাহাজীকরণ ও লজিস্টিক খরচ বহুগুণ বেড়েছে। নতুন নিয়মে রপ্তানির আগে সব পণ্যই বাধ্যতামূলকভাবে পরীক্ষাগারে যেতে হচ্ছে, যার ফলে প্রায় ১০ দিন পর্যন্ত বিলম্ব হচ্ছে।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল বলেন, "শুধুমাত্র ভোমরা বন্দরের ওপর নির্ভরশীল হয়ে আমরা অনেক সমস্যা ভোগ করছি। ভোমরা দিয়ে রপ্তানি করলে পরিবহন খরচ অনেক বেড়ে যায়, কারণ পণ্যগুলোকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়। এর ফলে ব্যবসার কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে এবং লাভ কমছে।"
তিনি আরও বলেন, "ভারত সরকার এই নিষেধাজ্ঞা তুলে না দিলে বাংলাদেশের প্রক্রিয়াজাত খাদ্য ও অন্যান্য পণ্যের রপ্তানি হুমকির মুখে পড়বে। আমাদের সরকারকে অবশ্যই কূটনৈতিক উদ্যোগ নিতে হবে যাতে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় থাকে।"
বম্বে সুইটসের ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস অ্যান্ড কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্সের জেনারেল ম্যানেজার খুরশিদ আহমেদ ফরহাদ মন্তব্য করেন, "ভারতে ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) রপ্তানি লক্ষণীয়ভাবে কমেছে। শুকনো খাবার রপ্তানি কমেছে প্রায় ১৪ শতাংশ, চিনি ও কনফেকশনারি পণ্যের রপ্তানি ১৭ থেকে ১৮ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে, পানীয় ও মসলার রপ্তানিতেও সামান্য হ্রাস দেখা দিয়েছে। এই প্রবণতা উদ্বেগজনক।"
তিনি বলেন, "খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও প্লাস্টিক খাতে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ পরিকল্পনা রয়েছে, কিন্তু এই পরিস্থিতিতে অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের পরিকল্পনা ঝুলিয়ে রেখেছে।"
অন্যদিকে, স্কয়ার ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী মো. পারভেজ সাইফুল ইসলাম জানান, "বন্দর নিষেধাজ্ঞার ফলে ভারতে বাজারে রপ্তানি করার প্রতিষ্ঠানগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে আমাদের প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বাজারে বেশি রপ্তানি করার কারণে এ ক্ষতির প্রভাব কিছুটা কমেছে।"
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চলতি অর্থবছরে কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্য রপ্তানায় ১৫ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল। কিন্তু স্থলবন্দর নিষেধাজ্ঞার কারণে এখন সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন অনেকটাই অসম্ভব বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
স্থানীয় ব্যবসায়ী ও বাণিজ্যিক সংগঠনগুলো বলছেন, ভারতের স্থলবন্দরগুলোতে নিষেধাজ্ঞা অতি দ্রুত তুলে নেওয়া উচিত। পাশাপাশি দুই দেশের মধ্যে মসৃণ বাণিজ্যিক সম্পর্ক রক্ষায় সরকারকে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নিতে হবে।
সরকারি ও বেসরকারি ব্যবসায়ী সূত্র জানাচ্ছেন, পণ্য পরিবহনের সময় অনেক বেড়েছে। শুধুমাত্র ভোমরা বন্দরের ওপর নির্ভরশীলতা ও বাধ্যতামূলক ল্যাব টেস্টের কারণে আমদানিকারক ও রপ্তানিকারকদের অতিরিক্ত সময় ও খরচ সহ্য করতে হচ্ছে।
এছাড়াও, বিভিন্ন বন্দরে অতিরিক্ত জটিলতা ও আমলাতন্ত্রের কারণে প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হচ্ছে, যা ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
ভারতের স্থলবন্দর নিষেধাজ্ঞার ফলে বাংলাদেশের কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রপ্তানি খাত বর্তমানে সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে। এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় দ্রুত সময়ের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক কূটনৈতিক আলোচনা ও ব্যবসায়িক প্রতিবন্ধকতা দূর করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রপ্তানি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই এই খাতে গতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন ও বাণিজ্য বাধা দূরীকরণে সরকার ও সংশ্লিষ্ট পক্ষের সক্রিয়তা অপরিহার্য।
অন্যথায়, এই নিষেধাজ্ঞা দেশের প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রপ্তানির সম্ভাবনাকে দীর্ঘমেয়াদি সংকটে ফেলতে পারে এবং কৃষিপণ্য খাতের সামগ্রিক উন্নয়নে বড় ধাক্কা হয়ে দাঁড়াবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ