
ছবি: সংগৃহীত
ট্রাম্প প্রশাসনের আরোপিত ৩৫ শতাংশ বাড়তি পালটা শুল্ক কমাতে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি দপ্তরে (ইউএসটিআর) আনুষ্ঠানিকভাবে চূড়ান্ত অবস্থানপত্র পাঠিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। মঙ্গলবার (২২ জুলাই) বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে ই-মেইলের মাধ্যমে এই অবস্থানপত্র প্রেরণ করা হয়। একইসঙ্গে ২৬ ও ২৭ জুলাই তৃতীয় দফা আলোচনা অনুষ্ঠানের অনুরোধও জানানো হয়েছে ইউএসটিআরকে। তবে আলোচনার সম্ভাবনা এখনো অনিশ্চিত।
অবস্থানপত্রে বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাস, শুল্ক-অশুল্ক বাধা দূরীকরণ, মার্কিন পণ্যের আমদানি বাড়ানোসহ বেশ কিছু কৌশলগত প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এই অবস্থানপত্র তৈরি করতে সরকারের শীর্ষ মহল থেকে শুরু করে নিরাপত্তা উপদেষ্টা, পররাষ্ট্র, অর্থ, কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয় পর্যন্ত অন্তত এক ডজন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের নিয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক করা হয়।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আগেও তৃতীয় দফা আলোচনার সময় চাওয়া হলেও ইউএসটিআর তা দেয়নি। বরং সোমবার একটি চিঠিতে সংস্থাটি জানায়, তাদের ব্যস্ততা এত বেশি যে শিগগিরই সময় দেওয়া সম্ভব নয়। বরং বাংলাদেশ যেন নিজ উদ্যোগে সময় নির্ধারণ করে যুক্তরাষ্ট্রে আসে—এই অনুরোধ করা হয়েছে।
বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান বলেন, "আমরা অবস্থানপত্রের পাশাপাশি আলোচনার জন্য আগামী সপ্তাহের সময় চেয়ে প্রস্তাব দিয়েছি। এটি আলোচনার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। এখন সিদ্ধান্ত ইউএসটিআরের ওপর নির্ভর করছে।"
আগামী ১ আগস্ট থেকেই ৩৫ শতাংশ পালটা শুল্ক কার্যকর হওয়ার কথা রয়েছে। অথচ এখনো এর বিষয়ে কোনো চূড়ান্ত সমঝোতা হয়নি। আগে এই হার ৩৭ শতাংশ নির্ধারণ করা হলেও ৮ জুলাই প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে চিঠি দিয়ে জানান, নতুন হার হবে ৩৫ শতাংশ। এরপরও উচ্চপর্যায়ের দুই দফা আলোচনা হলেও ওয়াশিংটনের মন গলাতে পারেনি ঢাকা।
এদিকে সময় যতই এগিয়ে যাচ্ছে, অনিশ্চয়তা ততই ঘনীভূত হচ্ছে। কারণ, আলোচনা ব্যর্থ হলে এই বাড়তি শুল্ক বাংলাদেশের পোশাক শিল্পসহ রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতিতে বড় আঘাত হানতে পারে।
বাংলাদেশ সরকার এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি নন-ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট (এনডিএ) সই করেছে, যার ফলে আলোচনার বিষয়বস্তু প্রকাশ করা যাচ্ছে না। এর ফলে ১৪ জুলাই অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করেও কোনো কার্যকর পরামর্শ নিতে পারেননি বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন।
এই বৈঠকে উপস্থিত থাকা ট্যারিফ কমিশনের সাবেক সদস্য মোস্তফা আবিদ খান বলেন, "আমাদের ডাকা হলেও কী আলোচনা হয়েছে তা পরিষ্কার করে বলা হয়নি। তাই কার্যকর পরামর্শ দেওয়ার সুযোগও ছিল না।"
অন্যদিকে, যেসব লবিস্ট এতদিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের হয়ে কাজ করছিলেন, তাদের অনেকেই এখন অন্য দেশগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছেন। ফলে বর্তমান পরিস্থিতিতে লবিস্ট নিয়োগ করাও কঠিন হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান।
তিনি বলেন, “আগামী কয়েকটা দিন খুব ইতিবাচক কিছু পাওয়ার আশা করা যাচ্ছে না। তবু আমরা চাই নতুন করে লবিস্ট নিয়োগ করতে, যাতে দরকষাকষি চালু থাকে।”
বাড়তি শুল্ক কমানোর বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সহানুভূতি আদায়ের জন্য বাংলাদেশ একাধিক কৌশল গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়ানোর ঘোষণা। ইতোমধ্যেই ৭ লাখ টন গম আমদানির জন্য সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। পাশাপাশি সয়াবিন, ডাল, চিনি, তেলবীজ ও বার্লি আমদানির পরিকল্পনা করা হয়েছে।
এছাড়া বোয়িংয়ের উড়োজাহাজ, এলএনজি এবং সামরিক সরঞ্জাম আমদানির প্রস্তাবও রাখা হয়েছে, যা ওয়াশিংটনের দৃষ্টিতে বাংলাদেশকে একজন ‘কৌশলগত বাণিজ্য অংশীদার’ হিসেবে চিহ্নিত করতে সহায়ক হতে পারে।
বাংলাদেশ সরকার মার্কিন পণ্যের ওপর প্রায় শতভাগ শুল্ক প্রত্যাহারের পরিকল্পনাও নিয়েছে, যার মধ্য দিয়ে ইউএসটিআরের দীর্ঘদিনের দাবি পূরণের চেষ্টা চলছে।
আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি—৪০ শতাংশ স্থানীয় মূল্য সংযোজনের শর্তেও—বাংলাদেশ সাড়া দিতে সম্মত হয়েছে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের চাহিদা অনুযায়ী বাণিজ্যিক সুবিধা দিতে চায় ঢাকা। তবে বাণিজ্য বিষয় ছাড়া অন্য কোনো রাজনৈতিক বা নিরাপত্তা শর্তে বাংলাদেশ রাজি হবে না—এমন অবস্থানও বৈঠকে স্পষ্ট করা হয়েছে।
যদিও ঢাকা শেষ মুহূর্তে চূড়ান্ত অবস্থানপত্র পাঠিয়ে এবং আলোচনার জন্য সময় প্রস্তাব দিয়ে নিজের পক্ষ থেকে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক দায়িত্ব পালন করেছে, তবুও আলোচনার অনিশ্চয়তা, এনডিএর সীমাবদ্ধতা এবং সময় সংকট পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলছে। এখন দেখার বিষয়, ইউএসটিআর আলোচনায় বসে কি না, আর বসলেও এই অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ কাঙ্ক্ষিত ছাড় আদায় করতে পারে কি না।
বাংলাবার্তা/এমএইচ