
থার্টি-ফার্স্ট নাইট
ঢাকা: ১৯৯৯ সালের থার্টি-ফার্স্ট নাইট (৩১শে ডিসেম্বর) একটি ভয়ংকর নৃশংসতার সাক্ষী ছিল সেই রাত। ১৯৯৯ সালে অর্থাৎ আজ থেকে ঠিক ২৪ বছর পূর্বে থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপনকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বরে ঘটে সেই নৃশংস ঘটনাটি।গভীর রাতে ‘বাঁধন’ নামের এক তরুণী প্রকাশ্যে যৌন হয়রানির স্বীকার হয়েছিল। মধ্যরাতে তরুনীকে বিবস্ত্র করার এই ঘটনায় সে সময় সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিলো। বাঁধন’ এর শ্লীলতাহানিতে জড়িত ছিলো ১০/১২ জনের একটি দল।
তন্মধ্যে প্রধান ছিলো বাংলাদেশের প্রথম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রসংগঠনের সাধারণ সম্পাদক জসিম উদ্দিন মানিক। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক জসিম উদ্দিন মানিকের মিষ্টি বিতরণ ও ধর্ষণের সেঞ্চুরির স্বঘোষিত ঘোষণায় সারা দেশের মানুষের বিবেককে নাড়া দিয়েছিলো, যার ফলে চত্বরে চত্বরে প্রতিবাদের ঝড় ওঠেছিলো।
বিভিন্ন গণমাধ্যমের মতে, তৎকালীন সময়ে জসিম উদ্দিন মানিক তার এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আত্নীয়ের হাত ধরে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে যোগ দিয়েছিলো এবং বিএনপি আমলে সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলো।
সে সময়ের সরকারী দলের বহু আলোচিত এমপি জয়নাল হাজারী এ ঘটনা তখন সংসদে সু-উচ্চ প্রতিবাদী কন্ঠে আলোচনা করেছিলেন এবং এই ঘটনার পর বিষয়টি তখন সারাদেশে আরও ব্যাপকভাবে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল। দিনের পর দিন পত্রিকার শিরোনাম ছিল বিষয়টি। সংসদেও ব্যাপক হৈচৈ হয়েছিল বিষয়টি নিয়ে। সব দিক থেকেই যারা বাঁধনকে লাঞ্চিত করেছিল তাদের বিরুদ্ধে যখন ফাঁসির দাবির ঝড় উঠেছিল সারাদেশে,তখন ঐ মুহূর্তে জয়নাল হাজারী সবাইকে অবাক করে দিয়ে পুরো দেশের বিরুদ্ধে গিয়ে উল্টো ভাষায় উত্তাপন করলেন, আমি শুধু মানিক ও তার সাথীদের নয়, বাঁধনেরও বিচার চাই।
এবার সারাদেশে আলোচনা-সমালোচনা আরো বেড়ে গেল। জয়নাল হাজারী বলেছিলো,বাঁধন ঘটনার সূত্রপাত ঘটিয়েছে। তা না হলে ঘটনাটি ঘটতোই না। ১৯৯৯ সালের থার্টি ফার্স্ট নাইট ছিল রমজান মাস এবং রমজান মাসের পবিত্র রাতের তিনটায় বাঁধন তার স্বামীর বন্ধুর হাত ধরে মাতাল অবস্থায় টিএসিতে গিয়েছিল এবং গাড়ি থেকে নেমেই বলেছিল আমি নাচতে এসেছি, কে নাচবে আমার সাথে, চলে এস। জয়নাল হাজারীর ভাষ্যমতে, একজন মুসলিম নারী রমজান মাসের রাত তিনটায় ঘরের বাইরে যেতে পারে না। বাঁধন শুধু ঘরের বাইরে নয়, যেখানে একটি মেয়েও নেই বরং কতগুলো মাতাল ছেলে মাতলামি করছিল সেখানে যেতে পারে না। তাছাড়া বাঁধন নিজেও মাতাল অবস্থায় সেখানে গিয়েছিল।
খবরে আরো দেখা গিয়েছিল, সে ঘর থেকে বেরিয়ে তার স্বামীর বন্ধুর সঙ্গে দুই ঘন্টা অন্য কোথাও ছিল। জয়নাল হাজারী আরও বলেছিলেন, স্বাভাবিকভাবে মানুষ যখন পথে সাপ দেখে কিংবা বাঘ দেখে সে পথে যায় না কিন্তু বাঁধন মাতাল ছেলেদের দেখেও সেখানে ঝাঁপিয়ে কেন পড়ল? এই প্রশ্নের উত্তর তাকেই দিতে হবে। মোট কথা আমার বিবেচনায় ঐ ঘটনাটির জন্য অবশ্যই বাঁধনও দায়ী ছিল। আর তাই সাহস করে অকপটে আমি তা সংসদে বলেছিলাম। জয়নাল হাজারীর এই বক্তব্যকে কেন্দ্র করে সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি বদলে গিয়েছিল। বেশির ভাগ মুসলমান তখন হাজারীর পক্ষেই অবস্থান নিয়েছিল।
কিন্তু কিছু গণমাধ্যমের মতে, সেদিন থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপন করতে বাঁধন, তার একজন বান্ধবী এবং বান্ধবীর স্বামী একটি গাড়িতে করে টিএসসিতে যায়। আর তখন মাতাল অবস্থায় গাড়িটি ঘিরে ধরে মানিকের দল। তারপর গাড়ি থেকে টেনে বের করে বাঁধনকে অসম্মানিত করা হয়।
বাঁধন নিপীড়নের ঘটনায় ২০০০ সালে একটি মামলা করা হয়েছিল, কিন্তু ১১ বছর মামলা চলার পর তিনজন আসামীর সবাই খালাস পেয়ে যায় এবং ঘটনাটি বিতর্কিতই থেকে যায়। জয়নাল হাজারীর এই ভূমিকা না থাকলে হয়তো মানিকদের দ্রুত ফাঁসি কার্যকর হত কিন্তু তা হয়নি। পরবর্তীতে দ্রুততম সময়ে বাঁধন গোপনে দুবাই পাড়ি দেয়। কিছুদিন পর বেশ কিছু গণমাধ্যমে উঠে আসে দুবাইয়ের একটি নাইট ক্লাবে বাঁধন নর্তকীর চাকরি নিয়েছে। নর্তকীটি বাঁধন এটি জানার পর প্রবাসী বাঙালিরা তাকে তাড়া করেছিল। সে তখন দুবাই থেকে গোপনে প্রাণ ভয়ে বাংলাদেশে ফিরে এসে আত্মগোপনে থাকে দীর্ঘদিন। পরে আবার গোপনে সে ব্যাংকক চলে যায়। এদিকে শ্লীলতাহানিতে জড়িত আসামিরা জামিন নিয়ে বিদেশে পাড়ি দিয়েছে। এরপর থেকে বাঁধনের আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি।
এরপরের বছর আবার জয়নাল হাজারী ঘোষণা দেয় ঢাকা শহরে রাতের অংশে থার্টি ফাস্ট নাইটে কোন মেয়েকে দেখা গেলে তার ঠ্যাং ভেঙ্গে দেয়া হবে। তাতেই সে বছর ঢাকা শহরে মেয়েরা সন্ধ্যার পর ঘর থেকে বের হয়নি। এরপর থেকেই থার্টি ফার্স্ট নাইটে ছাত্রীদের হলের বাইরে আসা বন্ধ করা হয়। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও কোনো তরুণীকে থার্টি ফার্স্টের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
এরপর থেকে প্রতি বছর সব ধরনের নৈতিক মূল্যবোধপরিপন্থি কর্মকাণ্ড এড়াতে ঢাকা মহানগরীতে নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সহযোগিতা করার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে অনুরোধ করা হয় এবং কিছু নির্দেশনা জারি করা হয়-
১। ঢাকা মহানগরের সার্বিক নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলার স্বার্থে রাস্তার মোড়, ফ্লাইওভার, রাস্তায় এবং প্রকাশ্য স্থানে কোনো ধরনের সভা, জমায়েত বা উৎসব করা যাবে না।
২। উন্মুক্ত স্থানে থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপন উপলক্ষে কোন ধরনের অনুষ্ঠান, সমাবেশ, নাচ, গান ও কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করা যাবে না।
৩। কোথাও কোন ধরনের আতশবাজি, পটকা ফোটানো ও ফানুস উড়ানো বা ক্রয়বিক্রয় করা যাবে না।
৪। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বসবাসরত শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা ৩১ ডিসেম্বর রাত ৮টার মধ্যে স্ব-স্ব এলাকায় প্রত্যাবর্তন করবেন এবং রাত ৮টার পরে প্রবেশের ক্ষেত্রে কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যদেরকে পরিচয়পত্র প্রদর্শন করতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সন্ধ্যা ৬টার পরে বহিরাগত কোনো ব্যক্তি বা যানবাহন প্রবেশ করতে পারবে না। শুধুমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টিকারযুক্ত যানবাহন পরিচয় প্রদান সাপেক্ষে প্রবেশ করতে পারবে।
৫। গুলশান, বনানী ও বারিধারা এলাকায় রাত ৮টার পর বহিরাগতরা প্রবেশ করতে পারবে না। তবে উক্ত এলাকায় বসবাসরত নাগরিকরা নির্ধারিত সময়ের পর কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউ (কাকলী ক্রসিং) এবং মহাখালী আমতলী ক্রসিং দিয়ে পরিচয় প্রদান সাপেক্ষে প্রবেশ করতে পারবে। একইভাবে ওই সময়ে সার্বিক নিরাপত্তার স্বার্থে গুলশান, বনানী, বারিধারা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকায় যে সব নাগরিক বসবাস করেন না তাদেরকে বর্ণিত এলাকায় গমনের ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত করা হলো। গুলশান, বনানী ও বারিধারা এলাকায় বসবাসরত নাগরিকরা ৩১ ডিসেম্বর রাত ৮টার মধ্যে স্ব-স্ব এলাকায় প্রত্যাবর্তনের জন্য অনুরোধ করা হলো।
৬। হাতিরঝিল এলাকায় সন্ধ্যা ৬টার পর থেকে কোনো সমাবেশ বা অনুষ্ঠান করা যাবে না এবং কোনো যানবাহন থামিয়ে অথবা পার্কিং করে কেউ অবস্থান করতে পারবে না।
৭। ৩১ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৬টার পর ঢাকা মহানগরীর কোনো বার খোলা রাখা যাবে না এবং ৩১ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৬টা থেকে ১ জানুয়ারি ভোর ৫টা পর্যন্ত ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন আবাসিক হোটেল, রেস্তোরাঁ, জনসমাবেশ ও উৎসবস্থলে সব ধরনের লাইসেন্স করা আগ্নেয়াস্ত্র বহন করা যাবে না।
৮। আবাসিক হোটেলগুলো সীমিত আকারে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় অনুষ্ঠান করতে পারবে।
এসব নির্দেশনা কি তবে নিজের বাড়ির ছাঁদের স্বাধীনতাও কেড়ে নিল? তবে কি নিরাপত্তার নামে উৎসব আয়োজনের অংশগ্রহণে বাঁধাপ্রাপ্ত হচ্ছে তরুণ সমাজ? এমন বিরূপ প্রশ্নের দেখা মিলছে বর্তমান তরুণ প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের মনে। আজকের দিনের নির্দেশনার প্রতি কেউ কেউ আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, এমন যদি হতো থার্টি ফার্স্ট নাইটে রাতের বেলার উদযাপন বন্ধুদের সাথে মধ্যরাতে হেঁটে হেঁটে দেখতে পারতাম! কেউ কেউ আবার নারীদের পুরোপুরি নিরাপত্তা ব্যবস্থা স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়নি বলেও হতাশা প্রকাশ করেন।
বাংলাবার্তা/এসজে