
ছবি: সংগৃহীত
ইসলামের সবচেয়ে পবিত্র স্থান কাবা শরিফ, যাকে বলা হয় ‘বাইতুল্লাহ’, ‘আল-বাইতুল হারাম’, ‘আল-বাইতুল আতীক’ এবং মুসলমানদের কেবলা—এটি শুধু একটি স্থাপত্য নিদর্শন নয়, বরং আধ্যাত্মিকতা, ইতিহাস ও ঐশী রহস্যে মোড়ানো এক অনন্য ইবাদতগাহ। বিশ্ব ইতিহাসের সর্বপ্রথম ইবাদতস্থল এই কাবাকে ঘিরে রয়েছে বহু ঐতিহাসিক নিদর্শন, অলৌকিক ঘটনা ও ইসলামী ঐতিহ্যের জীবন্ত স্মৃতি। কাবা শরিফ ও এর আশপাশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জানলে একজন মুসলমানের হৃদয়ে এক গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার অনুভব সৃষ্টি হয়। নিচে এসব স্থান নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা করা হলো—
কাবা শরিফের নির্মাণ ইতিহাস
ইতিহাস অনুসারে, কাবা শরিফ সর্বপ্রথম ফেরেশতাগণ নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে হযরত আদম (আ.)-এর হাতেও পুনর্নির্মিত হয়। এরপর বহুবার বিভিন্ন নবী ও মানবগোষ্ঠী এই গৃহের সংস্কার ও পুনর্নির্মাণ করে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়াত লাভের পাঁচ বছর পূর্বে কুরায়েশরা এটিকে বন্যার ধ্বংসাবশেষ থেকে রক্ষা করতে গিয়ে আবারও নির্মাণ করেন। এই নির্মাণ কাজে হালাল উপার্জনের সীমাবদ্ধতার কারণে কিছু অংশ বাদ যায়, যার ফলশ্রুতিতে সৃষ্টি হয় ‘হাতিম’ নামক স্থান।
হাতিম: বাইতুল্লাহর খণ্ডিত অংশ
কাবা শরিফের উত্তর দিক থেকে বাদ দেওয়া প্রায় তিন মিটার জায়গাটি হলো ‘হাতিম’। এটি বাইতুল্লাহর প্রকৃত অংশ হলেও নির্মাণকালে আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে কুরায়েশরা এই অংশটি বাদ দিয়ে দেয়। হাতিম অর্থ ‘খণ্ডিত’ বা ‘কর্তিত’। এটি অর্ধবৃত্তাকার একটি দেয়ালে ঘেরা এবং তাওয়াফ করার সময় এর বাইরে দিয়েই ঘোরা হয়, কারণ এর ভেতরে প্রবেশ করলে পুরো বাইতুল্লাহকে ঘিরে তাওয়াফ সম্পূর্ণ হয় না। তবে ধর্মীয় গুরুত্বের কারণে এটি অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ স্থান হিসেবে বিবেচিত।
মীযাবে রহমত: ছাদের পরনালা
কুরায়েশরা কাবার ছাদ নির্মাণের সময় ছাদের পানি বাইরে সরিয়ে নেওয়ার জন্য একটি পরনালা সংযোজন করে যা হাতিমের দিকে মুখ করে থাকে। এ পরনালাকে বলা হয় ‘মীযাবে রহমত’ বা ‘রহমতের ঝর্ণাধারা’। এই পরনালা দিয়ে যখন বৃষ্টি বা ওজুর পানি পড়ে, তখন মুসল্লিরা দোয়া কবুলের আশায় সেখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেন। এটি অত্যন্ত বরকতময় স্থান হিসেবে বিবেচিত।
কাবার গিলাফ: পবিত্র পরিধান
সবচেয়ে প্রাচীন বর্ণনামতে, হযরত ইসমাঈল (আ.) কাবা শরিফে প্রথম গিলাফ পরিধান করান। এরপর ইয়ামানের বাদশাহ আসআদ হিময়ারী তুব্বা’ এর ধারাবাহিকতা শুরু করেন। ইসলামী যুগে রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজ হাতে কাবাকে গিলাফ পরান এবং খোলাফায়ে রাশেদিন যুগেও এই প্রথা অব্যাহত থাকে। বর্তমানে সৌদি আরব সরকার ১৯৭৭ সালে মক্কায় বিশেষ একটি কারখানা স্থাপন করে, যেখানে বছরে একবার পবিত্র কাবার গিলাফ তৈরী হয়। এই গিলাফ কালো রঙের রেশম দিয়ে তৈরিকৃত এবং এতে সোনালি সূতায় কুরআনিক আয়াত লিপিবদ্ধ করা হয়।
হজরে আসওয়াদ: জান্নাত থেকে আগত পাথর
হজরে আসওয়াদ বা কালো পাথর কাবার দক্ষিণ-পূর্ব কোণে ১.১০ মিটার উচ্চতায় স্থাপিত। এটি জান্নাত থেকে আগত একটি পাথর যা একসময় ছিল দুধের চেয়েও সাদা। কিন্তু মানবজাতির গুনাহ এই পাথরকে কালো করে দিয়েছে। এই পাথর স্পর্শ ও চুম্বনের মাধ্যমে তাওয়াফ শুরু ও শেষ করা হয়। বর্তমানে এটি রূপার ফ্রেমে সুরক্ষিত এবং নিরাপত্তা ও মর্যাদার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত।
মাকামে ইবরাহিম: নবীর পদচিহ্ন
কাবার পূর্ব দিকে ১৩.৫ মিটার দূরে একটি পিতলের জালে ঘেরা পাথর রাখা আছে, যাকে ‘মাকামে ইবরাহিম’ বলা হয়। এই পাথরের উপর দাঁড়িয়ে হযরত ইবরাহিম (আ.) বাইতুল্লাহ নির্মাণ করেছিলেন। দেয়াল উঁচু হবার সাথে সাথে অলৌকিকভাবে এই পাথর উচ্চতা লাভ করত। এ পাথরের উপর হযরত ইবরাহিম (আ.)-এর পায়ের ছাপ এখনো স্পষ্টভাবে বিদ্যমান, যা মুসলমানদের জন্য একটি বিশেষ নিদর্শন ও স্মরণীয় চিহ্ন।
জমজম কূপ: অলৌকিক পানির উৎস
জমজম কূপ হচ্ছে ইসলামের ইতিহাসে অন্যতম অলৌকিক নিদর্শন। হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর জন্য তাঁর মা হাজেরা (আ.) যখন পানির খোঁজে ছুটে বেড়াচ্ছিলেন, তখন আল্লাহ তায়ালা জমজম কূপ সৃষ্টি করেন। ১৮ ফুট দৈর্ঘ্য, ১৪ ফুট প্রস্থ ও গড়পড়তা ৫ ফুট গভীরতা সম্পন্ন এই কূপ হাজার হাজার বছর ধরে তৃষ্ণার্ত মানবতার পিপাসা মিটিয়ে চলেছে। কোনো দিন শুকায়নি, কখনো নষ্ট হয়নি, এবং চিকিৎসাগতভাবেও এর পানিতে বহু রোগ নিরাময়ের ক্ষমতা রয়েছে বলে বহু হাদীস ও বর্ণনায় উল্লেখ রয়েছে।
মাতাফ: তাওয়াফের খোলা চত্বর
মাতাফ হলো কাবা শরিফকে কেন্দ্র করে নির্মিত খোলা চত্বর, যেখানে মুসল্লিরা তাওয়াফ করেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রা.) সর্বপ্রথম মাতাফকে পাকাকরণ করেন। সাম্প্রতিক সৌদি সংস্কারে এখানে সাদা রঙের বিশেষ মার্বেল পাথর স্থাপন করা হয়েছে যা রোদের তাপ শোষণ করে না, ফলে মুসল্লিরা খালি পায়ে অনায়াসে তাওয়াফ করতে পারেন। হজের সময় লক্ষ লক্ষ মানুষ এই মাতাফেই তাওয়াফ করেন।
মসজিদে হারাম: ইসলামের সর্ববৃহৎ মসজিদ
মসজিদে হারাম হলো কাবা শরিফের চারপাশে বিস্তৃত মসজিদ এলাকা। প্রথমদিকে এটি নির্মাণ হয়নি। হযরত উমর (রা.)-এর সময় থেকে মসজিদ নির্মাণ শুরু হয় এবং পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন খলীফা ও মুসলিম শাসকদের দ্বারা তা সম্প্রসারিত হতে থাকে। বর্তমানে এটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ মসজিদ, যেখানে একসঙ্গে ১০ লক্ষাধিক মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। রমজান, হজ ও ওমরাহ মৌসুমে এই মসজিদ মুসল্লিতে পরিপূর্ণ থাকে।
সাফা ও মারওয়া: ত্যাগ ও ধৈর্যের প্রতীক
সাফা ও মারওয়া দুইটি ছোট পাহাড় যা কাবা শরিফের পূর্ব-দক্ষিণ ও উত্তর-পূর্বদিকে অবস্থিত। হাজেরা (আ.)-এর বারবার ছুটোছুটি স্মরণে হজ ও ওমরাহ পালনকারীদের জন্য এই দুই পাহাড়ের মাঝে সাতবার দৌড়ানো (সাঈ) ফরজ করা হয়েছে। সাফা থেকে শুরু করে মারওয়ায় গিয়ে আবার ফিরে আসা পর্যন্ত মোট সাতবার ৩.১৫ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে হয়। এই দৌড় প্রতীক হয়ে আছে একজন মায়ের ত্যাগ, বিশ্বাস ও ধৈর্যের।
কাবা শরিফের আশপাশে অবস্থিত এই প্রতিটি স্থান ইসলামের ইতিহাস, আধ্যাত্মিকতা, ত্যাগ ও অলৌকিকতার এক একটি জীবন্ত সাক্ষ্য। একটি মুসলিমের জীবনে এগুলোর গুরুত্ব অতুলনীয়। যারা হজ ও ওমরাহ করতে যান, তাঁদের উচিত এসব স্থানের অর্থবহ ইতিহাস ও মর্যাদা ভালোভাবে জানা এবং সম্মানের সঙ্গে তা পরিদর্শন করা। প্রতিটি ইট, প্রতিটি চিহ্ন যেন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় ঈমান, একাগ্রতা ও আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণের শিক্ষা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ