
ছবি: সংগৃহীত
বর্তমান বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রেস সচিব শফিকুল আলম একটি ব্যক্তিগত ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে নিজের অভিজ্ঞতা, হতাশা এবং ভবিষ্যৎ প্রত্যাশা তুলে ধরেছেন, যা সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
তিনি বলেন, নিজের দায়িত্ব পালনকালে সরকারের নানা সিদ্ধান্ত এবং বিতর্কিত ইস্যুতে কথা বলতে গিয়ে তিনি যেমন দায়িত্বশীল মন্তব্য করার চেষ্টা করেছেন, তেমনি সেই মন্তব্য নিয়েই এখন সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হচ্ছেন। দীর্ঘদিন ধরে যারা তাঁর রাজনৈতিক সহযাত্রী ছিলেন, তারাও এখন শত্রুভাবাপন্ন আচরণ করছেন বলে অভিযোগ করেছেন প্রেস সচিব।
তার এই আবেগঘন ও আত্মবিশ্লেষণধর্মী পোস্টে উঠে এসেছে এক ব্যক্তি কীভাবে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, বন্ধুত্বের ছেদ এবং মূল্যবান সম্পর্কের ভাঙনের শিকার হন। তার মতে, তিনি এখন এমন এক অবস্থানে, যেখানে সব পক্ষই তাকে সন্দেহের চোখে দেখছে—একদা বন্ধু ছিল যারা, তারাও আজ দোষারোপ করছেন, আবার নতুন করে কেউ কেউ তাকে বিশ্বাসঘাতক বলেও অভিহিত করছেন।
সোমবার (২৬ মে) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট করা দীর্ঘ এক লেখায় শফিকুল আলম লেখেন, “শেখ হাসিনার শাসনামলে প্রায় ১৫ বছর ধরে, ক্ষমতাসীন দলের সদস্যরা এবং তাদের সমর্থকরা আমাকে নানা ধরণের তকমা দিয়েছিল। কিন্তু আমার বর্তমান পদ গ্রহণের পর, একটি নতুন গ্রুপ আমাকে বিশ্বাসঘাতক বলে অভিহিত করতে শুরু করে। কারণ আমার বেশ কয়েকটি প্রেস মন্তব্যে তারা ক্ষুব্ধ।”
তার ভাষায়, সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে যারা সবচেয়ে বেশি কঠোর ভাষায় তার সমালোচনা করেছে, তারা কেউই অচেনা নয়। তারা হলেন সেই পুরোনো দলের সদস্য, যারা একসময় শেখ হাসিনার শাসনামলে তার ঘনিষ্ঠ ফেসবুক বন্ধু এবং রাজনৈতিক সহকর্মী ছিলেন।
তিনি লিখেছেন, “সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলিতে, একটি পুরোনো দলের সদস্যদের কাছ থেকে সবচেয়ে কঠোর বার্তা এসেছে—যাদের অনেকেই শেখ হাসিনার আমলে আমার ফেসবুক বন্ধু এবং কমরেড ছিলেন। কিন্তু এখন তারা বিরক্ত, আমার বিরুদ্ধে অহংকার ও ধৃষ্টতা দেখানোর অভিযোগ এনেছে।”
প্রেস সচিবের এই লেখায় স্পষ্ট যে, দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে তিনি চেষ্টা করেছেন ন্যায্য ও নিরপেক্ষ থাকতে, কিন্তু কোনো পক্ষই তাতে সন্তুষ্ট হয়নি। একদিকে ক্ষমতাসীন দলের প্রতি ‘আনুগত্যের ঘাটতি’ অভিযোগ উঠেছে, অন্যদিকে নতুন দায়িত্ব গ্রহণের পর ‘পূর্বের দল’ তাকে বিশ্বাসঘাতক বলছে।
এই পরিস্থিতিতে তিনি অনুশোচনা করছেন না বলেই জানিয়েছেন। বরং তিনি লিখেছেন, “তবুও আমি এখানে আছি, জীবনের প্রতিটি ঘণ্টা গণনা করছি যা আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন। জীবন সুন্দর। আমি আশা করি যখন আমি অবসর মুহূর্ত খুঁজে পাব এবং যদি বেঁচে থাকি, তবে এই অস্থির সময় সম্পর্কে লিখব। তবে যদি না হয়, তবে কোনও অনুশোচনা নেই। গত পাঁচ দশক ধরে মতিঝিল কলোনির এই ছেলেটির প্রতি আল্লাহ সদয়।”
এই অংশটিতে উঠে এসেছে এক অভিজ্ঞ সরকারি কর্মকর্তার গভীর আত্মবিশ্বাস ও আস্থা—নিজের কাজ, মূল্যবোধ এবং জীবনের প্রতি কৃতজ্ঞতা।
বিশেষ করে "যদি বেঁচে থাকি, তবে এই অস্থির সময় সম্পর্কে লিখব" — এই বাক্যটি সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই উদ্ধৃত করছেন। কেউ বলছেন, প্রেস সচিব হয়তো অনেক কিছুর সাক্ষী হয়েছেন যা এখনও বলা যাচ্ছে না, আবার কেউ বলছেন এটি একজন মানুষের নিঃসঙ্গ দায়িত্ব পালনের সাক্ষ্য।
প্রেস সচিবের এই লেখায় একটি বড় ইঙ্গিত রয়েছে—বর্তমান সময়কে তিনি শুধু অস্থির নয়, ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য মনে করছেন। তিনি এমনকি সম্ভাব্য একটি আত্মজৈবনিক বা রাজনৈতিক স্মৃতিকথা লেখার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
এই বক্তব্যের পর রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সরকারের ভেতরের অজানা বহু ঘটনা হয়তো তিনি ভবিষ্যতে প্রকাশ করতে পারেন, যা শুধু তার অভিজ্ঞতাই নয়, বরং বর্তমান বাংলাদেশের রাজনীতির একটি অনন্য দলিল হয়ে উঠবে।
এই পোস্ট ছড়িয়ে পড়ার পর অনেকেই মন্তব্য করছেন, “একজন সৎ লোকের স্বীকারোক্তি এটা”, আবার কেউ কেউ বলছেন, “ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় সত্য বলা কত কঠিন, সেটাই প্রমাণ করলেন শফিকুল আলম।”
রাজনৈতিক মহলে কেউ কেউ এটিকে একটি আত্মরক্ষামূলক বার্তা বলেও ব্যাখ্যা করেছেন। কারণ এই মুহূর্তে অন্তর্বর্তী সরকার ও ড. ইউনূসের চারপাশে চাপা ক্ষোভ ও অসন্তোষ দানা বাঁধছে অনেক রাজনৈতিক মহলে।
প্রেস সচিব শফিকুল আলমের এই ফেসবুক পোস্ট যেন শুধু একটি অনুভবের প্রকাশ নয়, বরং একটি অস্থির সময়ের দলিল হয়ে উঠেছে। দায়িত্বশীল পদে থেকে নীরবে অনেক কিছু দেখার পর, আজ যখন পুরোনো বন্ধুরাও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, তখন তিনি তার হৃদয়ের কথা প্রকাশ করেছেন নিঃসঙ্কোচে।
আর এই প্রকাশের শেষ বাক্য যেন এক ইতিহাসের প্রতিশ্রুতি—“যদি বেঁচে থাকি, তবে লিখব।” সময়ই বলবে, সেই লেখাটি কবে আসবে, এবং কীভাবে বদলে দেবে বর্তমান অস্থিরতার পাঠ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ