
ছবি: সংগৃহীত
রাজধানীর অভিজাত এলাকা বারিধারায় অননুমোদিত সিসা বার পরিচালনার অভিযোগে আলোচিত অনলাইন ক্যাসিনো ব্যবসায়ী এবং বহুল আলোচিত ‘ক্যাসিনো ডন’ সেলিম মিয়া ওরফে সেলিম প্রধানসহ নয়জনকে গ্রেফতার করেছে গুলশান থানা পুলিশ। শনিবার (৬ সেপ্টেম্বর) ভোররাতে অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করা হয়। এ তথ্য নিশ্চিত করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান।
ডিসি তালেবুর রহমান জানান, গোপন তথ্যের ভিত্তিতে বারিধারা এলাকায় সেলিম প্রধানের মালিকানাধীন একটি সিসা বারে অভিযান চালানো হয়। সেখানে অননুমোদিতভাবে সিসা পরিবেশন ও বার পরিচালনার প্রমাণ মেলে। এসময় সেলিম প্রধানসহ আরও আটজনকে আটক করে থানায় নেওয়া হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা এ ধরনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে।
সেলিম প্রধানের নাম প্রথম আলোচনায় আসে ২০১৯ সালে, যখন দেশে ব্যাপক ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হয়। ওই বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর ভোরে তিনি থাইল্যান্ডগামী বিমানযোগে পালানোর চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে তাকে গ্রেফতার করে র্যাব। পরে তার বাসা ও অফিসে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ দেশি-বিদেশি মুদ্রা, সোনার বার এবং বিদেশি মদের মজুত উদ্ধার করা হয়।
পরবর্তীতে অর্থপাচার ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। এ মামলায় আদালত তাকে চার বছরের কারাদণ্ড দেন। তবে সেই শাস্তি ভোগের পাশাপাশি সেলিম প্রধান রাজনীতিতেও সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করেন। গত বছর নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ফৌজদারি মামলায় দণ্ডিত থাকায় নির্বাচন কমিশনের যাচাই-বাছাই শেষে তার মনোনয়নপত্র বাতিল হয়।
সেলিম প্রধান শুধু দেশে নয়, বিদেশেও ব্যবসা বিস্তার করেছেন। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) জানিয়েছে, থাইল্যান্ডে তার মালিকানাধীন সাতটি কোম্পানির সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে রয়েছে—প্রধান গ্লোবাল ট্রেডিং, এশিয়া ইউনাইটেড এন্টারটেইনমেন্ট, তমা হোম পাতায়া কোম্পানি লিমিটেডসহ আরও বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান।
এছাড়া ব্যাংকক ব্যাংক এবং সায়েম কমার্শিয়াল ব্যাংকে তার নামে প্রায় ২০ কোটি টাকার অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। শুধু থাইল্যান্ডেই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের নামকরা জেপি মর্গান ব্যাংকে সেলিম প্রধানের দুটি অ্যাকাউন্টে বিপুল অর্থ লেনদেনের প্রমাণ মিলে।
দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) মোজাম্মেল হক খান গণমাধ্যমকে বলেন, “তদন্তের স্বার্থে সেলিম প্রধানের সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ জব্দ করা হয়েছে। দেশে তার অর্ধশতাধিক ব্যাংক হিসাবও ফ্রিজ করা হয়েছে। বিদেশেও তার আর্থিক লেনদেনের খোঁজ মেলেছে। এগুলো বৈধ নয়, এগুলো অর্থপাচারের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত।”
শুধু ব্যবসা নয়, সেলিম প্রধানের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক বিতর্কও কম নেই। স্থানীয়ভাবে তার প্রভাব বিস্তারের নানা অভিযোগ রয়েছে। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে গ্রেফতারের পরও তিনি রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় থাকায় বেশ কিছু সময় আলোচনায় ছিলেন। এমনকি তার সমর্থকরা দাবি করেন, তিনি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন। কিন্তু দুদক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, তার বিরুদ্ধে প্রমাণিত অর্থপাচার ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগই তাকে বারবার আইনের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সেলিম প্রধানের মতো বিতর্কিত ব্যক্তিকে আবারও অননুমোদিত ব্যবসায় জড়িয়ে গ্রেফতার হওয়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির জন্য বড় প্রশ্ন। কারণ, পূর্বে দণ্ডিত হয়েও তিনি পুনরায় একই ধরনের অবৈধ কাজে যুক্ত হয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মনে করছে, রাজধানীতে অবৈধ সিসা বার ও ক্যাফে ব্যবসার পেছনে একটি প্রভাবশালী নেটওয়ার্ক কাজ করছে, যাদের সঙ্গে প্রবাসী অর্থপাচার চক্রও যুক্ত।
অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসার জন্য একসময়ে দেশজুড়ে আলোচিত সেলিম প্রধান আবারও গ্রেফতার হলেন অননুমোদিত সিসা বার পরিচালনার অভিযোগে। তার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যেই অর্থপাচার ও অবৈধ সম্পদের অভিযোগ রয়েছে। দেশে-বিদেশে ব্যবসা বিস্তার, অস্বাভাবিক আর্থিক লেনদেন এবং রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টার কারণে তিনি সবসময় বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, এবারও তার বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ